সিদ্ধান্তহীনতার মূল্য শিক্ষার্থীরা কেন দেবেন

সম্পাদকীয়

২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজের জন্য নতুনভাবে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির’ অধীন ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গভীর এক অনিশ্চয়তা, যার ভার পুরোপুরি বহন করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন পাঁচ মাসের ক্লাস শেষ করতে চলেছেন, এমনকি নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তিও আসন্ন, তখন সাত কলেজ এখনো ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করতেই পারেনি। রোববার ক্লাস শুরুর কথা থাকলেও ভর্তির সময় বাড়ানো হয়েছে। ক্লাস শুরুর নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ৩০ নভেম্বর। ভর্তি শেষ না হতেই সেশনজট এক নির্মম বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির কাঠামো, কর্তৃত্ব, কর্মপদ্ধতি— এখনো স্পষ্ট নয়। ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক স্পষ্টই জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি আইনসিদ্ধ নয়। ফলে তাঁদের পক্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রস্তুতিহীন অবস্থায় কেন ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু করা হলো? এর দায় কার?

সাত কলেজের সংকট নতুন কিছু নয়। ২০১৭ সালে যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল এ কলেজগুলোকে। এবার তা আবার বাতিল করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে কলেজগুলো চলছে অন্তর্বর্তী প্রশাসকের মাধ্যমে—একটি কাঠামোহীন, স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবস্থায়। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে আগস্টে, কিন্তু নভেম্বরের শেষভাগে এসেও ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হলো না—এর চেয়ে বিশৃঙ্খলা আর কী হতে পারে? শিক্ষকেরা তিন দিনের কর্মবিরতি পালন করেছেন; ভর্তি কার্যক্রম চালাতে হয়েছে কর্মচারীদের দিয়ে—এ দৃশ্য কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শুভসংকেত নয়।

সমস্যা আরও জটিল হয়েছে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় মডেলকে কেন্দ্র করে। হাইব্রিড কাঠামোর প্রস্তাবে ৪০ শতাংশ অনলাইন ও ৬০ শতাংশ সশরীর ক্লাস, এক বা একাধিক কলেজে বিভাগভিত্তিক পাঠদান, বিদ্যমান অনেক বিষয়ে কাটছাঁট—এসব নিয়ে শিক্ষক, উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী এবং স্নাতক–স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মধ্যে মতপার্থক্য গভীর। যখন ভবিষ্যৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোই অনিশ্চিত, তখন প্রথম বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম বা ক্লাস শুরু করা কি জেনেশুনেই সেশনজটকে আমন্ত্রণ জানানো নয়?

শিক্ষা প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে যে ভুল করে আসছে, সেটি হলো সমস্যাকে বোঝার আগেই ‘সমাধান’ ঘোষণা করা। ২০১৭ সালে অনেকের আপত্তি অগ্রাহ্য করে অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত যেমন ছিল অপরিণামদর্শী, এবারও তাড়াহুড়া করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা দিয়ে সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। অথচ শিক্ষকেরা বলছেন, একটি অধিভুক্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয় করলেই সহজ সমাধান পাওয়া যেত। আবার উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের সময় প্রথমে যে মডেল ভেবেছিলেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রেখে ক্যাম্পাসের বাইরে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো—সেটাও বাস্তবসম্মত ছিল। কারণ, নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, অন্যদিকে আবার বিপুল খরচের বিষয়ও আছে। কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে জটিল এক হাইব্রিড মডেলের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় থাকাটা স্বাভাবিক।

এ পরিস্থিতি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; এটি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতায়ও আঘাত। সেশনজট মানে শুধু সময় নষ্ট নয়, শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে যাওয়া, কর্মজীবনে প্রবেশে বিলম্ব, পরিবারগুলোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি এবং দেশে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ঘাটতি হওয়া।

এ রকম অবস্থায় এখনই জরুরি তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে : ১. প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো দ্রুত, স্বচ্ছভাবে এবং শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত করা; ২. বর্তমান শিক্ষাবর্ষের ভর্তি ও ক্লাস শুরুকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সেশনজট রোধ করা এবং ৩. সাত কলেজের দীর্ঘমেয়াদি প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার জন্য পরিষ্কার পথনকশা ঘোষণা করা।

শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বারবার এমন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলতে পারে না। সাত কলেজের সংকট সমাধানে বাস্তবতা ও দায়িত্বশীলতার ওপর ভিত্তি করে নীতিনির্ধারকদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনোভাবেই শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবারকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা যাবে না।