আর কত প্রতিশ্রুতি, বাস্তব পদক্ষেপ নিন

বাংলাদেশে কন্যাশিশুর ওপর যৌন সহিংসতার যে ভয়াবহতা চলতি বছরের প্রথম আট মাসের পরিসংখ্যানে ফুটে উঠেছে, তা থেকে বোঝা যায় আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মেয়েদের জন্য কতটা অনিরাপদ। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মাত্র আট মাসে ৩৯০টি কন্যাশিশু ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হয় নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র ও দেশ গঠনে আমরা কতটা আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে আছি। 

 ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৪৩টি শিশু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ২৯টি প্রতিবন্ধী শিশুও রয়েছে। ধর্ষণের পর ১৫টি শিশুকে খুন করা হয়েছে, ৫টি শিশু আত্মহত্যা করেছে। এত ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ও সরকারের নানা প্রতিশ্রুতির পরও শিশুদের এমন নিরাপত্তাহীনতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ প্রতিবেদনের ভয়াবহ দিক হলো, সহিংসতার মাত্রা তুলনায় বেড়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে যেখানে ২২৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, ২০২৪ সালে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯০–এ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ধর্ষণের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে আইন আছে, কিন্তু তার কার্যকারিতা নেই। কন্যাশিশুরা আজ ঘরেও নিরাপদ নয়, স্কুলেও নয়, এমনকি ধর্মীয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নয়। সমাজে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি যে ঘৃণা, অবমূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি গেঁথে আছে, তা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ভুক্তভোগীদের আত্মীয় বা পরিচিত। অর্থাৎ যেসব মানুষের শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তারাই হয়ে উঠছে যৌন সহিংসতার উৎস। এটি কেবল অপরাধ নয়, একটি ভয়াবহ সামাজিক বিকৃতি, যেখানে পারিবারিক সম্পর্কও নিরাপত্তা দিতে পারছে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১০৪টি কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে, ৮৩টি শিশু খুন হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ঘটনার বিচার কোথায়? বিচারব্যবস্থার অকার্যকারিতা, মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা এবং সামাজিক প্রভাবের কারণে ধর্ষণ মামলার আসামিরা প্রায়ই খালাস পেয়ে যায়। ধর্ষণের পর খুনের মতো জঘন্য অপরাধেও যখন বিচারের নিশ্চয়তা থাকে না, তখন অপরাধীরা আরও সাহস পায়। আইনের ভয় না থাকাই তাদের অপরাধের প্রধান প্ররোচনা হয়ে দাঁড়ায়।

বাল্যবিবাহ ও সাইবার বুলিং বেড়ে যাওয়াও এই অকার্যকর আইনের ফল। আইন প্রয়োগে শৈথিল্য এবং সামাজিক জবাবদিহির অভাব কন্যাশিশুদের জীবনে নতুন নতুন হুমকি তৈরি করছে। এখন তারা কেবল শারীরিক নয়, ডিজিটাল পরিসরেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পুরুষতন্ত্র এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেছে যে নারীদের ‘অধস্তন’ ভাবা এখন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির অংশ। আমরা একদিকে নারী অধিকার নিয়ে উচ্চকিত, অন্যদিকে প্রতিদিন সংবাদপত্রে কন্যাশিশুর ধর্ষণের খবর পড়ে নির্বিকার থাকি। রাষ্ট্র, সমাজ, আইন—সবকিছু যেন এক অদ্ভুত নীরবতায় আচ্ছন্ন।

রাষ্ট্র যদি সত্যিই শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়, তবে এটি কেবল পুলিশি বা আইনি বিষয় হিসেবে না দেখে সামাজিক নীতি ও নৈতিকতার সংকট হিসেবে দেখতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংগঠন—সব জায়গাতেই শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি বিশেষ অধ্যাদেশের প্রস্তাব দিয়েছে। এটি জরুরি প্রস্তাব হলেও এমন পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা। পাশাপাশি ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। আমরা সরকারের আর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি শুনতে চাই না। শিক্ষাব্যবস্থায় লিঙ্গসংবেদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং ডিজিটাল পরিসরে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পরিবার ও সমাজে কন্যাশিশুর প্রতি সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।