সীমিত আয়ের মানুষকে একটু স্বস্তি দিন

সম্পাদকীয়

একটানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সাফল্য ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যার মধ্যে খাদ্যপণ্যে এর হার ১০ শতাংশের বেশি। সম্প্রতি বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য দিলেন, খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ১৫ শতাংশে।

এ অবস্থায় দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের অবস্থা কতটা শোচনীয় হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) চলতি মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনার খরচ ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালে মাথাপিছু খরচ ছিল ১ হাজার ৮৫১ টাকা, গত ফেব্রুয়ারিতে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯২৩ টাকায়।

সেই তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। তাহলে তাঁরা এই ঘাটতি কীভাবে মেটান? প্রথমত, সংসারের অন্যান্য খরচ কমিয়ে। কেউ কেউ সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করেন। ডব্লিউএফপির তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে ছিল; যা এর আগের মাসের তুলনায় ২ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আর ৪৩ শতাংশ মানুষ বাকিতে খাবার কিনছে। ২২ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ খরচ কমিয়েছে। আর ১৩ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় ভাঙছে। বাকিতে খাদ্য কিনলে তো একসময় দাম পরিশোধ করতে হবে। মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিলে চড়া সুদসহ সেটা পরিশোধ করতে হবে। খাদ্যঝুঁকিতে থাকা ২১ শতাংশ মানুষ যে বাইরে থেকে সহায়তা পাচ্ছে, তা–ও অপ্রতুল।

একদিকে আমরা প্রতিবছর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ার বয়ান শুনি, অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটে চলেছে। এর পেছনে রহস্যটা কী? বাজারে খাদ্যপণ্যের অভাব নেই, অভাব হলো সেটি কেনার সামর্থ্যের। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে দাবি করেন। কিন্তু সেটি কজনের? বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আয়ের সঙ্গে যে ব্যয়ের সামঞ্জস্য নেই, ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনই তার প্রমাণ। খাদ্যপণ্যের দামের কথা এলেই মন্ত্রীরা রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দেন। কিন্তু এই যুদ্ধের অভিঘাত পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও পড়েছে। তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমরা পারলাম না কেন? দেউলিয়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো শ্রীলঙ্কা যদি ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দুই বছরে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে, বাংলাদেশে তা ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছাবে কেন? ভারতেও মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের কাছাকাছি।

মন্ত্রীদের দাবি অনুযায়ী, মানুষের আয়ই যদি বাড়বে, তাহলে তাঁরা প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার কিনছেন কেন? খাবার কিনতে তাঁদের সঞ্চয় ভাঙতে কিংবা ধারকর্জ করতে হচ্ছে কেন? খাদ্যঝুঁকিতে থাকা মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ বাইরে থেকে সহায়তা পাচ্ছে, সেটা যথেষ্ট নয়।

আমাদের প্রধান সমস্যা বাজার ব্যবস্থাপনা। গত ঈদের আগে সরকার বেশ কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল; কার্যকর করতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা তাঁদের দামেই বিক্রি করেছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমত বাজারে সরকারের তদারকি জোরদার করতে হবে, যাতে অদৃশ্য খেলোয়াড়দের রাশ টেনে ধরা যায়। এর পাশাপাশি খোলাবাজারে চাল, আটা, ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিক্রি বাড়াতে হবে। সেটা অবশ্যই মৌসুমি বা বড় শহরকেন্দ্রিক হলে হবে না; সারা বছর ও শহর–গ্রামনির্বিশেষে সবখানে এই কর্মসূচি চালু রাখতে হবে। এতে হয়তো গরিব মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবেন।