কেনাকাটা ও নিয়োগে অনিয়ম কি চলবেই

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, লাইনচ্যুত ট্রেনের চাকা বা দেবে যাওয়া রেললাইন ওপরের দিকে তোলার জন্য যে লিফটিং জ্যাক ব্যবহার করা হয়, তা ভারত থেকে আমদানি করতে খরচ হয় ১৯ হাজার টাকা। রেলওয়ে কিনেছে ৩ লাখ টাকায়।

একইভাবে তারা ৬৫ হাজার টাকার ড্রিলিং মেশিন কিনেছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকায়। এটা বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। কাটিং ডিস্ক নামের আরেকটি মেশিন তারা কিনেছে বাজারমূল্যের ৮ গুণ বেশি দামে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) অধীন ট্রাক সাপ্লাই কর্মকর্তার (টিএসও) কার্যালয় থেকে চার ধরনের ২৮টি মেশিন কেনা হয়েছে দুই কোটি টাকায়। অথচ এসব মেশিনের বাজারমূল্য সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কেনা এসব কেনাকাটায় দুর্নীতি ও আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি উঠে আসে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) প্রতিবেদনে।

এ ছাড়া রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অধীন প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বিভাগের আরঅ্যান্ডআই শাখার টিনের কার্যালয় মেরামতের জন্য বরাদ্দ ২ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানা গেছে প্রতিষ্ঠানটির আরেক প্রতিবেদনে। কেনাকাটায় অনিয়মে পিছিয়ে নেই রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলও। বাজারে ৮ ইঞ্চির ছোট পাইপ রেঞ্জের দাম ২২০ টাকা। তারা কিনেছে ৬ হাজার ৪৭৫ টাকায়। এ ছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় মালামাল কিনেছে বাজারদরের চেয়ে ২ থেকে ৫ গুণ দামে।

কেবল কেনাকাটা নয়, লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও রেলওয়েতে দুর্নীতি-অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ আছে। ২০১৭ সালে আরএনবির সিপাহি চতুর্থ শ্রেণির ১৮৫টি পদে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, আসামিরা সিপাহি নিয়োগের কমিটিতে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা, পোষ্য কোটার প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ দেখিয়ে ওই কোটায় পছন্দের প্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া বিভাগীয় কোটা, জেলা কোটা, পোষ্য কোটাসহ অন্যান্য কোটাবিধি যথাযথভাবে মানা হয়নি। রেলওয়ের দুর্নীতি–অনিয়ম নিয়ে সংসদের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম প্রায়ই দেশবাসীকে রেলওয়ের নতুন নতুন প্রকল্পের কথা শোনান। কিন্তু সেসব প্রকল্পে কী পরিমাণ দুর্নীতি-অপচয় হচ্ছে, সেসব বিবরণ সংবাদমাধ্যমে এলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। গত বছর ডিসেম্বরে মন্ত্রী নিজেই রেলওয়ের দুই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র) দিয়েছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। নিজের মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পক্ষে এভাবে ডিও লেটার দেওয়া যায় কি না, সেটাও প্রশ্ন।

নতুন নতুন রেললাইন হচ্ছে, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন যাবে, এটা খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু রেলওয়ের দুই প্রধান খাত কেনাকাটা ও নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে, সেগুলো বন্ধে কোনো পদক্ষেপ তিনি নিচ্ছেন না কেন? সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১৩ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর রেলওয়ের কালো বিড়াল মারার কথা বলেছিলেন। দুর্ভাগ্য, তিনি নিজেই কিছুদিন পর দুর্নীতির জালে আটকা পড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর রেলওয়েতে একের পর এক মন্ত্রী বদল হলেও দুর্নীতি–অনিয়ম কমে না। আগের আমলের দায় বর্তমান মন্ত্রী এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ২০১৯ সালের পর রেলওয়েতে কেনাকাটা ও নিয়োগ–পদোন্নতিতে যেসব অনিয়ম হয়েছে, সেই দায় তিনি এড়াবেন কীভাবে?