গণতন্ত্রে জনগণই নিয়ামক শক্তি

সম্পাদকীয়

ভারতের সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই নিয়ামক শক্তি। তীব্র বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেও যে সব দল ও পক্ষ মিলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা সম্ভব, ভারতের ৬৪ কোটি ভোটার তা প্রমাণ করেছেন। আমরা ভারতের গণতন্ত্রকামী জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানাই।

ভারতের এবারের নির্বাচনের ফলাফল আগাম নানা ভবিষ্যদ্বাণী ও হিসাব–নিকাশ থেকে অনেকটাই ভিন্ন হয়েছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কিন্তু গত দুই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে এককভাবে সরকার গঠনের অবস্থায় ছিল, এবারে তা নেই। এনডিএ জোটের শরিকদের সহায়তায় নরেন্দ্র মোদিকে সরকার গঠন করতে হবে, যাদের অনেকের সঙ্গে রাজনৈতিক ও আদর্শগত ফারাক আছে বিজেপির। অন্যদিকে এই নির্বাচনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোট আশাতীতভাবে ভালো ফল করেছে।

এই নির্বাচনের ফলাফল যে সত্যকে প্রকাশ করেছে, তা হচ্ছে বিজেপির ভেদনীতি ও হিন্দুত্ববাদ ভোটারদের কাছে আগের চেয়ে গুরুত্ব হারিয়েছে। শুধু এর ওপর ভিত্তি করে জনগণের আস্থা ও সমর্থন ধরে রাখা যায় না। দেশ পরিচালনায় সরকার কতটা দক্ষ, আর্থসামাজিক নীতিগুলো কতটা জনমুখী, জনগণ তার সুফল পাচ্ছে কি না, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে কি না—এসব বিবেচনা ভোটারদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এবারের নির্বাচনে ভারতের বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে তাদের নির্বাচনী প্রচারে আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকারের ব্যর্থতা, জনজীবনের নানা সমস্যা, দুর্নীতি ও বৈষম্যের দিকগুলোকেই তুলে ধরেছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ভালো ফল করার পেছনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি গত ১০ বছরে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মোদি সরকারের বিভিন্ন ভুল নীতিও ভূমিকা রেখেছে। এবারের নির্বাচনের ফলাফল তাই দুই পক্ষের জন্যই শিক্ষণীয় অনেক কিছু তুলে ধরেছে।

ভারতের নির্বাচন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, ভারতে নির্বাচনের ফল বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রকামীদের সামান্য নিশ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু অবস্থার বদল ঘটবে কি না, তা নির্ভর করে ভারতের নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনীতিবিদেরা তাঁদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখছেন কি না, তার ওপর।

যেকোনো দেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং শক্তিশালী বিরোধী দল অপরিহার্য। ভারতের গত দুই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভূমিধস বিজয় এবং বিরোধী দলগুলোর দুর্বল অবস্থান ভারতের গণতন্ত্রের অবনমন ঘটিয়েছে। নিরঙ্কুশ ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী বিজেপি ধর্মীয় ভেদনীতি ও বৈষম্যপূর্ণ নাগরিক আইনসহ দমনমূলক এমন অনেক নীতি নিয়েছে, যা দেশটির সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। দেশটির সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছেও তা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মূল চেতনার পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় এবং তা সংশোধনের সুযোগ তৈরি হয়। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। ভারতের এবারের নির্বাচনের ফলাফল সেই বার্তাই দিয়েছে।

ভারতের এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্যও একটি বড় শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে। ৭৭ বছর বয়সী স্বাধীন ভারতে এক দিনের জন্যও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে সেটি ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়ে বড় পার্থক্য নেই। রাজনৈতিক বিষয়ে পার্থক্যটিও ভারতের মতো প্রকট নয়। এরপরও অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন থেকে এখন অনেক দূরে সরে গেছে বাংলাদেশ।

দুই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এরপরও তিস্তার পানিবণ্টনসহ অনেক বিষয় অমীমাংসিত থেকে গেছে। ভারতের নতুন সরকারের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাচ্ছেন। আমরা আশা করতে পারি, ভারতের নতুন সরকার অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেবে।