আঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে

সম্পাদকীয়

গত কয়েক দিনে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা, অপহরণ ও অস্ত্র লুটের ঘটনা যেমন সেখানকার জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ফেলেছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি তৈরি করেছে।

এই সশস্ত্র গোষ্ঠী এর আগেও বান্দরবানে বিভিন্ন সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের হাতে সেনাবাহিনীর সদস্যসহ অনেকে জীবন দিয়েছেন। বান্দরবানের গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণশিবির খুলে তারা একটি ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মোটা অঙ্কের তহবিলও গঠন করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সেই প্রশিক্ষণশিবির বন্ধ হয়েছে এবং একই সঙ্গে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়। বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার নেতৃত্বে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা চলমান থাকা অবস্থাতেই নতুন করে এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটল।

এসব সন্ত্রাসী ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ কার্যত শান্তি উদ্যোগের প্রতি তাদের অনাস্থাকেই তুলে ধরেছে। অন্যদিকে এর মধ্য দিয়ে তারা সম্ভবত নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যেরও প্রমাণ দিতে চেয়েছে। শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে নেতৃত্বের বিরোধ থেকেও সংগঠনের কোনো একটি অংশ এই ঘটনা ঘটাতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করেন।

প্রশ্ন উঠেছে, কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কি যথেষ্ট ছিল? যদি তেমন কিছু নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সশস্ত্র গোষ্ঠী স্বল্প সময়ে এতগুলো হামলার ঘটনা ঘটাল কীভাবে? এটা সবার জানা যে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে এবং সেখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাও জোরালো। কেএনএফ এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে কিংবা এর প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে, এ–সংক্রান্ত কোনো আগাম তথ্য না পাওয়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।

সর্বশেষ হামলার পর সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী সমন্বিত অভিযান চালিয়েছে। র‍্যাবের হাতে কেএনএফের ‘প্রধান সমন্বয়কারী’ গ্রেপ্তার হয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বান্দরবান সফর করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

কেএনএফের বিরুদ্ধে অভিযানের ক্ষেত্রে যেমন সমন্বয়হীনতার প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেসব বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতেও বিভ্রান্তির সুযোগ রয়েছে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে বাইরের কারও সংযোগ নেই। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীর ইন্ধন থাকতে পারে। কেএনএফের হামলা নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। জাতীয় নিরাপত্তা–সংক্রান্ত বিষয়ে রাজনৈতিক বিভক্তি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকেই উৎসাহিত করে।

কেএনএফ এমন সময়ে হামলা চালিয়েছে, যখন প্রতিবেশী মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি ও অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ এবং ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতেও জাতিগত বিরোধ জোরদার হয়েছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দিয়ে কেএনএফের শক্তিকে বিচার করলে হবে না। কেএনএফের এই তৎপরতাকে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে।

আমরা মনে করি, কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতা ও হামলার ঘটনাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কেএনএফের তৎপরতার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশ ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ জাতিগত বিরোধ ও সংঘাতের যেমন সম্পর্ক থাকতে পারে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনও কাজ করে থাকতে পারে। অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি ওই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণেও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই।