যেকোনো দেশে শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি আর্থসামাজিক অবস্থা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জন্মের সময় শিশু অপুষ্ট ও অপরিণত থাকলে পরবর্তী সময়ে নানা রকম স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হয়।
গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে শিশুস্বাস্থ্যের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩২ লাখ সন্তান জন্ম নেয়, যার মধ্যে ৬ লাখ শিশু অপরিণত। এটা মোট শিশুজন্মের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ। অপরিণত বা কম ওজনের জন্ম নেওয়া শিশু নানা জটিলতায় ভোগে এবং এই শিশুদের একটি বড় অংশের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম থাকে।
এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চিত্রও সুখকর নয়। ২০২০ সালে জন্ম নেওয়া ১৩ কোটি ৫০ লাখ শিশুর মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৫৩ লাখই কম ওজন বা অপরিণত অবস্থায় জন্ম নিয়েছে। ওই বছর যে ২০ লাখ ৪০ হাজার নবজাতক মারা যায়, তার অর্ধেক বা ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অপরিণত অবস্থায় বা কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে।
সম্মেলনে অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি সামিনা চৌধুরী বলেন, প্রসবপূর্ব স্বাস্থ্যসেবার জন্য একজন মায়ের কমপক্ষে আটবার চিকিৎসক বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে যাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে মায়েদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মাত্র একবার এবং ৪১ শতাংশ দুবার গিয়ে থাকেন।
গুণগত প্রসবপূর্ব সেবা হলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক অন্তত একবার গর্ভবতী নারীকে দেখবেন। এর পাশাপাশি তাঁর ওজন ঠিক আছে কি না, ব্লাডপ্রেশার দেখা হয়েছে কি না, ইউরিন টেস্ট করা হয়েছে কি না, ব্লাড টেস্ট এবং প্রেগন্যান্সি নিয়ে কাউন্সেলিং করা হয়েছে কি না, এই পাঁচ বিষয়েও তদারক করা প্রয়োজন।
২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ শিশু সময়ের আগেই জন্ম নেয় বলে জানানো হয়েছিল। এদের মধ্যে ২৩ হাজার ৬০০ শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যায়।
এই অপরিণত শিশু জন্মের অন্যতম কারণ হচ্ছে মায়ের পুষ্টিহীনতা ও অল্প বয়সে বিয়ে। অর্থাৎ অপরিণত শিশুর জন্মের সঙ্গে মায়ের স্বাস্থ্য ও বয়সের বিষয়টিও সম্পৃক্ত। মায়ের বাল্যবয়সে বিয়ে হলে শিশুও অপরিণত ও অপুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি।
শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়। অথচ ইউরোপে ৯ শতাংশ ও যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ শতাংশ ব্যয় করা হয় স্বাস্থ্য খাতে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হারও কম।
স্বাস্থ্যসেবায় আমরা যতই উন্নতির দাবি করি না কেন, অপরিণত শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের পিছিয়ে পড়া ১০ দেশের মধ্যে সপ্তম। পরিস্থিতির উত্তরণে সব মায়ের প্রসবপূর্ব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
একই সঙ্গে বাল্যবিবাহ রোধ করতে আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে। আশা করি, নীতিনির্ধারকেরা ‘সবকিছু ঠিক আছে’ মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে অপরিণত শিশু জন্ম রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।