আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের যেখানে জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা, সেখানে তাঁরা ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দু–একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে মানুষ পুলিশের কাছে পরিষেবা নিতে যেতে চান না; আর গেলেও তাঁরা প্রতিকারের বদলে ভোগান্তির শিকার হন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার কমিশন ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে একটি জনমত জরিপ করে, যা খুবই কার্যকর বলে ধারণা করি। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে অনেক বিষয়ে সরকারি–বেসরকারি সংস্থাগুলো মতামত নিয়ে থাকে, যার সঙ্গে বাস্তবের তেমন মিল থাকে না। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মতামতে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের জরিপে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, যার মধ্যে সর্বাধিক ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ বলেছে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ চাই। অন্যদিকে আইনের প্রতি অনুগত ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ চায় যথাক্রমে ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৮৪ শতাংশ। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দেন ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন এই জনমত জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেয় গত ৩১ অক্টোবর। জরিপে অংশ নেন ২৪ হাজার ৪৪২ জন। তাঁদের মধ্যে ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষ প্রায় ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন ২৩ হাজার ১৯১ জন, অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ। নারী ছিলেন ১ হাজার ২৫১ জন বা ৫ শতাংশ।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তদন্তে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সংগঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন ৬০ শতাংশ মানুষ। হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত স্থায়ী তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলেছে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে ক্ষমতা অর্পণের কথা বলেছেন ২০ শতাংশ মানুষ। ৪১ শতাংশ স্বাধীন ‘পুলিশ ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় পুলিশি হেফাজতে বা রিমান্ডে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের ধারাটি সংশোধন ও সংস্কার চান প্রায় ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা। তল্লাশির সময় পুলিশ পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে বা বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করতে চাইলে, তার প্রতিকারের একটি কার্যকর কল সার্ভিস চালুর পক্ষে মত দিয়েছেন ৮৭ শতাংশ উত্তরদাতা।
কমিশন যাঁদের নিয়ে জরিপ করেছে, তাঁদের বেশির ভাগ চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী। তাঁরা সামাজিকভাবে কমবেশি প্রভাবশালী। কিন্তু তাঁরা শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষকে জরিপে যুক্ত করলে পুলিশ সম্পর্কে আরও বেশি নেতিবাচক চিত্র পেত। তবে জরিপে বেশ কিছু ইতিবাচক ঘটনাও উঠে এসেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’। এই সেবায় ৫৭ শতাংশ সন্তুষ্ট বলে জানানো হয়েছে, সন্তুষ্ট নয় ৩২ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে জাতীয় জরুরি সেবা নিয়ে আরও বেশি প্রচার হওয়া দরকার। বর্তমানে শহরাঞ্চলেই এই সেবার উপকারভোগী বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন, যাতে প্রান্তিক মানুষেরা উপকৃত হয়।
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, কমিশন পুলিশের আইন ও কাঠামো সংস্কারের জরিপের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী গঠন করতে পারলে, তাদের মধ্যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রাও কমবে।
জনগণ সত্যিকার অর্থে একটি গণমুখী পুলিশ বাহিনী প্রত্যাশা করে, যারা সব ধরনের অন্যায় প্রভাবের বাইরে থেকে সততার সঙ্গে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করবে। পুলিশ প্রকৃতই জনগণের বন্ধু হবে।