নৈরাজ্য বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার

সম্পাদকীয়

বাইরে বের হলে প্রিয়জন যেন নিরাপদে ঘরে ফেরে—বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে সহজ প্রত্যাশা হলেও বাস্তবে দিন দিন সড়ক আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। চার বছর আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে পুরো সমাজকে ঝাঁকুনি দেওয়া কিশোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকার নানা আশ্বাস দিলেও বাস্তবে অবস্থার তো কোনো উন্নতি হয়ইনি, বরং নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা বেড়েছে বহুগুণ। কার্যত শাসনহীন সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের মহামারি কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।

২ জানুয়ারি রেড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন থেকে ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৫৪৮ জন।

চার বছরের মধ্যে সড়ক ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন থেকেও জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাও সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করে। নিয়মিতভাবে এসব পরিসংখ্যান জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। চালক-যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি নীতিনির্ধারক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়, সে উদ্দেশ্য থেকেই এটি করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা শুধু কাগজে-কলমের পরিসংখ্যান হিসেবেই থেকে যায়। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যুগোপযোগী নীতি প্রণয়ন না করা এবং আইনের প্রয়োগ ও নজরদারি না থাকায় দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকে। একেকটা দুর্ঘটনা একেকটা পারিবারিক ও মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেয়।

৩ জানুয়ারি প্রথম আলোর একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বাঁচার জন্য রক্ত নিতে যাচ্ছিল শিশুটি, সড়কে প্রাণ গেল’। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যাচ্ছে, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পাঁচ বছরের একটি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতি মাসে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন। সেই রক্ত নিতে গিয়েই বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারাতে হয় শিশুটিকে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছয় ছেলের মৃত্যু হয় মা মৃণালিনী সুশীলের।

তিনি বলেছেন, ‘তাঁর মতো যাঁরা সন্তান হারিয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরাই বুঝবেন জীবন কত কঠিন, কত কষ্টের।’ মৃণালিনীর এই আর্তি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারানো প্রতিটি পরিবারের কণ্ঠস্বর নয় কি? নিছক পরিসংখ্যান নয়, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে পারিবারিক বিপর্যয় বলে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম ব্যক্তি হতাহত হওয়ায় অর্থনীতির ওপরও এর প্রভাব পড়ছে।

বুয়েটসহ নানা সংস্থার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কে বাস-ট্রাকের মতো ভারী ও দ্রুতগতির যানের সঙ্গে মোটরসাইকেল-ইজিবাইকের মতো হালকা ও ধীরগতির যানও গণপরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানাচ্ছে, ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যেখানে ৯৪৫ জন নিহত হন, ২০২২ সালে সেখানে নিহত হন ২ হাজার ৫৩৩ জন। এর আবার বড় একটা অংশ কিশোর ও তরুণ। প্রশ্ন হলো, গণপরিবহনব্যবস্থায় এ ধরনের ভুল নীতিতে আর কত মানুষকে জীবন দিতে হবে?

সড়কে নৈরাজ্য কেন হয়, কী করলে শৃঙ্খলা ফিরবে, তা নিয়ে যথেষ্ট কথাবার্তা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময়ে নির্দেশনাও জারিও হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা কথার কথা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া সড়কের নৈরাজ্য বন্ধ হবে কীভাবে?