আমরা এতটা পিছিয়ে কেন

সম্পাদকীয়

‘কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী গড়ি: সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করি’ স্লোগান নিয়ে এ বছর যখন সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস পালিত হলো, তখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্রটি হতাশাজনকই বলতে হবে।

আমাদের সংবিধানেও জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু সত্য হলো স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও আমরা সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারিনি। অনেকে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, আবার অনেকে ভুল ও অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক যুগে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় বেশ কিছু অগ্রগতি আছে; যেমন মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার কমা, শিশুপুষ্টির উন্নতি, শিশুদের টিকা দেওয়ার হার বৃদ্ধি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১০ সালের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ন্যায্যতার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, মানুষ অসুস্থতার সময় তার সাধ্য বা সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে। স্বাস্থ্যসেবা নিতে কাউকে আর্থিক ঝুঁকিতে পড়তে হবে না।

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে ২৪ শতাংশ পরিবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। এ হার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এ হার সবচেয়ে কম ভুটানে। দেশটির ১ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার এ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।

ভারতে এ হার ১৬ শতাংশ, মিয়ানমারে ১৪ শতাংশ, নেপালে ১০ শতাংশ। অন্য সব দেশে ৬ শতাংশের কম। পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হলে তাকে বলা হয় বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হলে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে, অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়। চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে বাংলাদেশে নিঃস্ব হওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো চিকিৎসায় ব্যয় বেশি হলে মানুষ চিকিৎসাসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকে।

বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কিন্তু যে হারে আয় বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়; বিশেষ করে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অনেকের সর্বস্বান্ত হওয়ার উদাহরণও আছে। সমাজের বিত্তবান মানুষ বেশি অর্থ ব্যয় করে বিদেশে বা দেশের নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারেন এবং তা তাঁরা করেনও।

কিন্তু দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের একমাত্র ভরসা যে সরকারি হাসপাতাল, সেখানে ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। বড় শহরগুলোর বাইরে যেসব সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে, সেখানেও চিকিৎসাসেবা পাওয়া আরও দুর্লভ। অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় সংখ্যক, চিকিৎসক, সেবিকা, টেকনিশিয়ান থাকেন না। আবার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে গিয়েও সর্বস্বান্ত ও প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও কম নয়।

করোনাকালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুর্বলতা প্রকট রূপে ধরা পড়ার পরও এ খাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানা যায় না। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি, লোকবল ও অবকাঠামোর উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটের প্রায় ৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ব্যয় দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১২ শতাংশ হওয়া উচিত। কেননা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ভবিষ্যতের জন্য বড় বিনিয়োগও বটে। তাই বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি তা কোথায় ও কীভাবে খরচ হচ্ছে, সে বিষয়ে তদারক জোরদার করতে হবে। গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে দেশের সব মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার বিষয়টিও।