বিএনপির প্রতি সরকারের আচরণ অগ্রহণযোগ্য

সম্পাদকীয়

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন সাংবিধানিক অধিকার। এরপরও সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে সম্প্রতি ঘোষণা এসেছিল, বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না।

কিন্তু গত কয়েক দিনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ অন্যান্য কর্মসূচিতে শুধু বাধাই দেওয়া হয়নি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলপ্রয়োগ কোথাও কোথাও ভয়ংকরভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এতে সহিংসতা ও প্রাণহানিও ঘটেছে। আবার এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গণহারে বিএনপির লোকজনকেই আসামি করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রের বরাতে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বিএনপিকে আর পুরো শক্তি নিয়ে আন্দোলনে নামতে দেবে না সরকার। বিএনপি নামতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোরভাবে তা দমনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরও প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। এ নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হন যুবদলের কর্মী শাওন প্রধান। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিরাজগঞ্জে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের ইটপাটকেলের পাল্টা হিসেবে পুলিশ গুলি, লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেছে। এর আগে ভোলায় বিএনপির কর্মসূচিতে গুলিতে দুজন নিহত হন।

চার জেলায় সংঘর্ষের পর বিএনপির ৪ হাজার ৮১ নেতা-কর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে। স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ নেতার নাম উল্লেখ করে অন্যদের অজ্ঞাতপরিচয় রাখা হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের শায়েস্তার কাজে এ ধরনের মামলা ব্যবহার করা হয়। গণগ্রেপ্তার ও গণহয়রানির ঘটনা ঘটে।

নারায়ণগঞ্জে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে যুবদলের কর্মী নিহতের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে, তাতেও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ‘বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অবৈধ অস্ত্রের গুলি ও ইটের আঘাতে’ নিহত হন শাওন। ফলে এ মামলাও বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের শঙ্কা রয়েছে।

তবে সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মামলার বাদী (নিহত শাওনের ভাই) দাবি করেছেন, তিনি মামলা করেননি। অভিযোগ রয়েছে, শাওনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়াসহ নানা হয়রানি করা হয়েছে। গভীর রাতে বিপুলসংখ্যক পুলিশের কড়া পাহারায় লাশ হস্তান্তর ও দাফন করা হয়। আওয়ামী লীগ ও পুলিশ নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে—এমন অভিযোগও করেছেন স্বজনেরা।

নারায়ণগঞ্জে সংঘর্ষের সময়কার যে ছবি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশের পোশাক পরা এক সদস্য গুলি ছুড়ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কর্মসূচির নামে বিএনপি পুলিশের ওপর হামলা শুরু করেছে। যেসব জায়গায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে, সেসব জায়গায় বাধা দেওয়া হচ্ছে না। আত্মরক্ষার প্রয়োজন পড়লে পুলিশ কি বসে থাকবে? কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। বিভিন্ন জায়গায় মোটরসাইকেলে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরের বেশি সময় বাকি। এরই মধ্যে সরকার ও বিরোধী দলে রাজনৈতিক উত্তাপ দেখা দিয়েছে। বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না—সরকারের এমন বক্তব্যে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ বেড়েছিল।

এ পরিস্থিতিতে সরকার তার ‘উদারতায়’ রাশ টেনে ধরে বিএনপির ওপর কঠোর অবস্থান নিতে শুরু করেছে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধাদান কোনো অর্থেই যৌক্তিক নয়। কোনো কর্মসূচিতে সহিংসতা হলে তা ছত্রভঙ্গ করার বহু উপায় পুলিশের রয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গুলি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।