কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, আদর্শ ধারণ করুন

আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যে মহান নেতা এ দেশের স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন, পাকিস্তানিরা ফাঁসির হুকুম দিয়েও যাঁকে মারতে পারেনি, তিনিই কিনা সপরিবার নিহত হলেন তাঁর দেশের মানুষের হাতে। এটি ইতিহাসের এক মহা ট্র্যাজেডি।

১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীতে একের পর এক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে। তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে ৩ নভেম্বর। এ শাসন স্বল্পস্থায়ী হলেও তিনি ও তাঁর অনুসারীরা খুনি চক্রকে দেশত্যাগ ও রাষ্ট্রপতি পদ থেকে খন্দকার মোশতাক আহমদকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। নতুন রাষ্ট্রপতি হন প্রধান বিচারপতি আবুসাদত মোহাম্মদ সায়েম। ৭ নভেম্বর কথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবে খালেদ মোশাররফ নিহত হন। এরপর ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসেন জিয়াউর রহমান।

ক্ষমতা গ্রহণের ৮৩ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দেশত্যাগে বাধ্য হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অপচ্ছায়া থেকে গেছে বহুদিন। খন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের আমলে এই ইনডেমনিটি জাতীয় সংসদে আইনি বৈধতা পায়। শুধু তা–ই নয়, তাঁর সরকার খুনিদের বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়েছে; যা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এটা ছিল দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাঁরা হলেন লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)। বঙ্গবন্ধু হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি আবদুল মাজেদ ভারতের কলকাতায় পালিয়ে ছিলেন; সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে ২০২১ সালের ১০ এপ্রিল তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এখনো পাঁচ আসামি—খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন এবং এস এইচ নূর চৌধুরী বিদেশে পলাতক। অপর আসামি আজিজ পাশা বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা যান। বিদেশে পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রয়াস অব্যাহত আছে বলে সরকার দাবি করলেও কার্যত অগ্রগতি নেই। এঁদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় ও রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। বিদেশে পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ সাড়ে ১৩ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় আছে। জাতীয় সংসদেও তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। এ অবস্থায় দেশবাসী দেখতে চায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও সরকার কেবল আনুষ্ঠানিকতায়, সভা-সেমিনারে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে না; তাঁর নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের সচেষ্ট থাকবে। যে রাজনৈতিক আদর্শের জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন; সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠাই হতে পারে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন।

৪৭ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যাঁরা নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁদের সবাইকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি।