সভা-সমাবেশে শ্রদ্ধাশীলতা কাম্য

সম্পাদকীয়

উন্নয়নের সুফল জনগণের প্রতিটি স্তরে পৌঁছাতে গেলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক নানা অনুশীলনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার বিস্তৃত করা হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে যেন এর উল্টো যাত্রা চলছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারচর্চার সুযোগ ও নাগরিক সংগঠনগুলোর স্থায়িত্বশীলতা নিয়ে সম্প্রতি যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে, তা উদ্বেগজনক।

মতপ্রকাশ, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও প্রতিবাদ করার মতো সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিক অধিকারচর্চার ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে করছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। বিদায়ী ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো, সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, সাধারণ নাগরিকসহ সবাইকে নানামুখী প্রতিকূলতার শিকার হতে হয়েছে।

আসক বলছে, ২০২২ সালে সারা দেশে ৪৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭০ জন। আহত হন ৬ হাজার ৯১৪ জন। বন্দুকযুদ্ধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন পাঁচজন।

নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৯৪টি। খুন হয়েছেন ১২৬ নারী। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১২ জন নারী। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৫টি। এ ধরনের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪৭৪ শিশু। বিদায়ী বছর সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ২১ জন। গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩৬ জন। কারা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের।

এ ছাড়া ২০২২ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর ১২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২১০ সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।

দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আসক কেন ‘বিভীষিকাময়’ বলেছে, তা এসব তথ্য থেকেই স্পষ্ট। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কারণে বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। ২০২১ সালে র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

আসকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় বিচারবহির্ভূত হত্যা কমলেও তা একেবারে বন্ধ হয়নি। গুম, অপহরণ, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও বন্ধ হয়নি।

আসকের নির্বাহী পরিচালক বিচারবহির্ভূত হত্যা পুরোপুরি বন্ধের পাশাপাশি গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনা বন্ধে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন এবং জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার কথা বলেছেন। আমরাও মনে করি, সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সম্প্রতি প্রকাশিত ইউএসএআইডির সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনস সাসটেইনেবিলিটি ইনডেক্সের (সিএসওএসআই) বৈশ্বিক প্রতিবেদন ২০২১-এ বলা হয়েছে, নাগরিক সংগঠনগুলোর বৈশ্বিক স্থায়িত্বশীলতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২০২১ সালেও আগের বছরের মতো সংকুচিত থেকে গেছে।

আইনি জটিলতা, মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অর্থায়নের অনিশ্চয়তার মতো চলমান সংকটের সঙ্গে কোভিড পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

অনলাইন পরিসরের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তার অপব্যবহার মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে অনলাইনেও নাগরিক অধিকারচর্চা সংকুচিত হচ্ছে।

অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে এ ধরনের আইনে মতপ্রকাশের অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারায় পরিবর্তন আনা জরুরি। রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তির শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের ওপর শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে সরকারকে।

নাগরিক সংগঠনগুলো যাতে স্থায়িত্বশীল হতে পারে, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত করা।