এত আওয়াজ সত্ত্বেও কেন পিছিয়ে বাংলাদেশ

ডিজিটালের পর যখন সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছে, তখন ইন্টারনেট ব্যবহারে আমাদের পিছিয়ে থাকা মোটেই স্বস্তির খবর নয়। বিশ্বব্যাংকের ‘ডিজিটাল অগ্রগতি ও প্রবণতা প্রতিবেদন ২০২৩’-এ দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩৯ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এই হার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ প্রতিবেশী এবং সমপর্যায়ের অর্থনীতির বিভিন্ন দেশের তুলনায় কম। 

প্রতিবেদনে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসাক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহারসহ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন সূচকে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার নয়; স্মার্টফোন ব্যবহার, ইন্টারনেটের গতি, ব্যবসায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর হার ৫১.৭৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। 

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের শ্রেণিভুক্ত। এই শ্রেণিভুক্ত দেশগুলোতে গড়ে জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ে হার ৪২ শতাংশ। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান যুক্ত করা হয়নি বলে এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস প্রতিবেদন ২০২৩–এ দেশের পাঁচ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে বলে জানানো হয়েছে। আইসিটি সচিবের বক্তব্য সঠিক হলেও বাংলাদেশের অবস্থান খুব বেশি বদলায় না। এর বিপরীতে ভারতে ৪৬, মালদ্বীপে ৮৬, নেপালে ৫২, ভুটানে ৮৬ ও শ্রীলঙ্কায় ৪৪ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। 

বাংলাদেশের মানুষ কেন ইন্টারনেট ব্যবহার কম করেন, তা উঠে আসে ‘ব্রডব্যান্ড কমিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ওই প্রতিবেদনে জিএসএমের (মোবাইল অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন) তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়, মুঠোফোন থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া ২৬ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনই মনে করেন না এবং সামর্থ্য না থাকায় ব্যবহার করেন না ১১ শতাংশ। আবার ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণেও অনেক ব্যবহারকারী আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশের জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার প্রায় ৫২ শতাংশ। হারটি দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। আফগানিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে (৫৬ শতাংশ)।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে আসছেন। যদিও এ রকম ডিজিটাল দেশ গড়ার ঘোষণা অন্য কোনো দেশ দিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে এক ধাপ এগিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থেকে এটা কি সম্ভব?

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাশুল তুলনামূলক কম হওয়া সত্ত্বেও কেন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে না, সেটি অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির জন্য প্রতিটি নাগরিকের যে অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সামর্থ্য গড়ে তোলা প্রয়োজন, সেটা আমরা অর্জন করতে পারিনি। সমাজে ধনী মানুষের হার যেমন বাড়ছে, তেমনি দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে (হারের দিক থেকে কিছুটা অগ্রগতি হলেও)।

তাই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে নাগরিকের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও শিক্ষাগত দক্ষতাও বাড়াতে হবে। ইন্টারনেটে অর্থনৈতিক লেনদেন বেড়েছে, এটা আশার কথা। কিন্তু এই লেনদেনকারীদেরও একাংশ তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। কম সময়ে লেনদেন করতে পারেন বলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এই সুবিধা নিয়ে থাকেন।