অধিকারের কর্মীর কারাদণ্ড: মানবাধিকারকর্মীদের প্রতি দমনমূলক নীতি নয়

সম্পাদকীয়

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গায়েবি মামলা, গণগ্রেপ্তারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র সমালোচনার মুখে থাকা সরকার মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসির উদ্দিনকে (এলান) জেলে পাঠিয়ে নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েছে। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত তাঁদের দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।

রায় ঘোষণার সময় এজলাসে খাঁচায় বন্দী কিংবা প্রিজন ভ্যানে এই দুই মানবাধিকারকর্মীর ছবি মুহূর্তের মধ্যেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষকেরাও আদালতে হাজির ছিলেন। রায় ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ফ্রান্স, জার্মানি ছাড়াও ৭২টি মানবাধিকার সংগঠন এই দুই মানবাধিকারকর্মীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে।

অধিকারের নিবন্ধন সরকার আগেই বাতিল করেছিল। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ভিন্নমত দমনে নতুন তৎপরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে এই রায়। আর বিবিসি সমালোচকদের বরাতে বলেছে, নির্বাচনের আগে সরকারের দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে এই রায় এল।

আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের প্রেক্ষাপটে দুটি জিডি হয়েছিল।

মোটাদাগে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করা। তাঁদের আইনজীবী মোহাম্মদ রুহুল আমিন ভূঁইয়া প্রথম আলোর কাছে বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুরুতর অসংগতির অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর বাদীপক্ষের আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা পুনঃ তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করার ঘটনা বিরল।

আদিলুর ও অধিকারের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৬১ জন নিহত হওয়ার অসত্য তথ্য প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। আইনজীবীর দাবি, অধিকার এই তথ্য কোথাও প্রচার করেনি এবং এই তালিকাও অধিকারের নয়। যে তালিকা পুলিশ আদালতে উপস্থাপন করেছে, সেখানে ২৫ জনের নামের পাশে এখনো নিশ্চিত নয়—এমন কথা লেখা ছিল। পুলিশ ওই তালিকায় থাকা সবার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করেনি। ফলে তালিকাটি সত্য না অসত্য, তা–ও পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসেনি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে অধিকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান করে এসেছে। এ কথা সত্য, বিশ্বব্যাপী অপতথ্য ও ভুল তথ্যের ব্যাপক প্রচার এখন রাষ্ট্র, সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যথার কারণ।

জাতিসংঘ এই সমস্যা মোকাবিলায় সত্য তথ্য স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যাপক ভিত্তিতে প্রচারের পরামর্শ দিয়েছে। তবে কোনো অবস্থাতেই মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া যাবে না, এই হলো তাদের পর্যবেক্ষণ। সেই জায়গায় সরকার হাঁটল উল্টো পথে। তারা মানবাধিকারকর্মীদের জেলে পুরল। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় যে অধিকার যে তালিকা দিয়েছিল তা ভুল, তারপরও মানবাধিকারকর্মীদের জেলে পাঠানো নিন্দনীয়; কোনো অজুহাতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

সরকার কি আসলে এই বার্তা দিতে চায় যে সরকারি বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে চোখ বুজে থাকতে হবে?

এর ব্যত্যয় হলেই হয়রানির মুখে পড়তে হবে? মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। তবে ‘দ্বার বন্ধ’ রাখলেই সত্য চাপা থাকবে—এ যুগে এ বোধ হয় আর সম্ভব নয়। ভুক্তভোগী মানুষ ঠিকই কোনো না কোনো মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য প্রকাশ করবেন।

মানবাধিকারকর্মীদের ওপর সরকারের দমনমূলক নীতি অগ্রহণযোগ্য।