ইসরায়েলি আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধ হোক

সম্পাদকীয়

গত বছরের ৮ অক্টোবরের পর থেকে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় নির্বিচার মানুষ হত্যা করে চলেছে। আন্তর্জাতিক মহলের কোনো প্রতিবাদ, নিন্দা ও আহ্বান তাদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। ইতিমধ্যে সেখানে মৃত মানুষের সংখ্যা ২৬ হাজার ছাড়িয়েছে, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ প্রেক্ষাপটে নেদারল্যান্ডসের হেগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রতি দৃষ্টি ছিল বিশ্বের শান্তিকামী প্রত্যেক মানুষের। আদালতের রায় পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আদালতের সামনে ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ দেখিয়ে আসছিলেন।

আইসিজে ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যা ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। একই সঙ্গে নির্বিচার হামলায় বিধ্বস্ত উপত্যকাটিতে মানবিক বিপর্যয় উত্তরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা এক মাসের মধ্যে জানাতে বলেছেন আদালত। এটি ছিল অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ। পূর্ণাঙ্গ আদেশ পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

উল্লেখ্য, গাজায় গণহত্যার অভিযোগ এনে গত ২৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে একদা বর্ণবাদের শিকার দক্ষিণ আফ্রিকা। ১১ ও ১২ জানুয়ারি মামলার শুনানি হয়। শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবীরা গাজায় যুদ্ধ বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। ইসরায়েল বরাবরের মতো গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আমাদের প্রত্যাশা ছিল, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ইসরায়েলকে সরাসরি গণহত্যা বন্ধ করতে বলবেন। তাঁরা তা বলেননি কিন্তু এরপরও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই রায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক আদালতের সভাপতি জোয়ান ডানেহিউ অন্তর্বর্তী রায়ে বলেন, গাজায় গণহত্যা বলে বিবেচিত হতে পারে—এমন কর্মকাণ্ড বন্ধে ইসরায়েলকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এমনকি সেখানে গণহত্যায় কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে দেশটিকে।

ইসরায়েলের সম্প্রসারণ নীতি ও যুদ্ধোন্মাদনা লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে কেবল মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করেনি; গাজায় তৈরি হয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়। যে সময় আইসিজে গণহত্যা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে, সে সময়ও ইসরায়েল গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিল।

আইসিজের আদেশের পর ফিলিস্তিনিরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালিকি ও স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা আত্মরক্ষার অজুহাত খাড়া করে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু যুদ্ধবাজ এই শাসকদের জানা উচিত যে আত্মরক্ষার অধিকার মানে কোনো ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান চালিয়ে সেখানকার নিরীহ মানুষ এবং শিশু ও নারীদের হত্যা করা নয়। আত্মরক্ষার অধিকার মানে হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে চিকিৎসাধীন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া নয়।

যে রাষ্ট্রটি ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নৃশংসতা চালিয়ে আসছে, সেই রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় এই রায় মানবে না। ইসরায়েল রাষ্ট্রটি এক দিনে সভ্যতাবিরোধী দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। শুরু থেকে তারা পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থ ও অস্ত্র পেয়ে আসছে।

ইসরায়েলি শাসকদের ঔদ্ধত্য এতটাই বেড়েছে যে এখন যুক্তরাষ্ট্রের কথাও তারা কানে নিচ্ছে না। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন দুই রাষ্ট্রনীতি মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারও বিরোধিতা করছে তেল আবিব।

নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলতে চাই, এর মাধ্যমে ইসরায়েলের মুখোশ যেমন উন্মোচিত হলো, তেমনি নৈতিক চাপও বাড়বে। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধ করতে বিশ্বের সব শান্তিকামী মানুষ এবং দেশ আরও জোরালো ভূমিকা নেবে, এটাই প্রত্যাশিত।