রাজনৈতিক বিরোধের শিকার শিক্ষার্থীরা কেন হবে?

সম্পাদকীয়

দেশে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা নিয়ে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সেটি কারও কাছেই কাম্য হতে পারে না। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।

কেননা কোভিড মহামারির সময় নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের বড় অংশই এমনিতেই শিখনঘাটতির সমস্যায় ভুগছে। হরতাল, অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদের শিক্ষাজীবন যদি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটা হবে তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এখন শিক্ষাবর্ষের শেষ সময় চলছে। আগামী বছর জানুয়ারি মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ কারণে এ বছর নভেম্বরেই বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা বিভাগ। কিছু কিছু স্কুলে পরীক্ষা শুরুও হয়ে গেছে। তবে বেশির ভাগ স্কুলে শেষ পর্যায়ের পাঠদান চলছে।

হরতাল, অবরোধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় তিন কোটি পড়ুয়ার পড়াশোনা নিয়ে একধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কেননা যানবাহনে আগুনের ঘটনায় ভয় নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। অভিভাবকদের মনেও উদ্বেগ কাজ করছে। অবরোধের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে চলছে, তা নিয়ে প্রথম আলো ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তরের ২৮টি স্কুলের তথ্য সংগ্রহ করেছে।

তাতে দেখা যাচ্ছে, অবরোধের কারণে ঢাকার শহর এলাকায় এবং ঢাকার বাইরের শহর এলাকার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে। শিক্ষার্থীসংকটে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে একেবারেই ক্লাস হচ্ছে না। তবে ঢাকার বাইরে এবং ঢাকার অনেক এলাকায় আবার শিক্ষার্থী উপস্থিতি ও পাঠদান স্বাভাবিক রয়েছে।

কোভিড মহামারিকালে একটি প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের শিক্ষণের যে ক্ষতি হয়েছে, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও বহুমুখী। সম্প্রতি গণসাক্ষরতা অভিযান কোভিড-পরবর্তী শিখন পরিস্থিতির ওপর যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংস্থাটি বলছে, আমাদের ক্রমাবনতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা করোনায় হোঁচট খেয়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার গতি কমে এসেছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে।

করোনাকালে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিখনক্ষতি নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গবেষণায় প্রায় একই তথ্য পাওয়া গেছে। এনসিটিবি জানিয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আগে থেকেই শেখার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। করোনা মহামারিতে প্রায় দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সেই ঘাটতি আরও বেড়েছে। গণিত, ইংরেজির মতো বিষয়ে শিখনক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি।

মহামারির শিখনক্ষতি কাটিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে। এ বাস্তবতায় রাজনৈতিক অস্থিরতা যে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁদের এই উপলব্ধি সবার আগে থাকা প্রয়োজন। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে শুধু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বার্ষিক পরীক্ষায়ই প্রভাব পড়বে না, আগামী বছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতিও ব্যাহত হতে পারে।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর এক দিন হরতাল ও পাঁচ দিন অবরোধ হয়েছে। আজ আবার দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। সামনেও একই ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।

আমরা মনে করি, রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হলো আলাপ-আলোচনা। রাজনৈতিক বিরোধে শিক্ষার্থীরা কেন বলির পাঁঠা হবে? শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে যাতে নতুন কোনো অনিশ্চয়তা তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে সরকারি দল, বিরোধী দল—সব পক্ষকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।