দায়মুক্তির সংস্কৃতি অপরাধ বাড়াচ্ছে

সম্পাদকীয়

ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে পোশাক কারখানার কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা এবং লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার ঘরে আগুন দেওয়ায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা দুটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। এক দিনের ব্যবধানে এই দুটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড নাগরিকদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। এটি নিশ্চিত করেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং রাষ্ট্র ও সরকারের দায়মুক্তি সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। এতে নাগরিকদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে, সেটা প্রশমনের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের বরাতে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত বৃহস্পতিবার ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পাইওনিয়ার্স নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেডের কর্মী দীপু চন্দ্র দাসকে কারখানা থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একপর্যায়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভাজকে একটি গাছে বিবস্ত্র করে ঝুলিয়ে মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় র‍্যাব-পুলিশ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। র‍্যাব ১৪-এর অধিনায়ক নয়মুল হাসান বলেছেন, ‘ধর্ম অবমাননার বিষয়টি খুবই অস্পষ্ট। তিনি কী বলেছেন, এটা খোঁজার চেষ্টা করলেও কেউ এটা বলতে পারেনি।’ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী, কারা এর সঙ্গে জড়িত, তদন্ত করে বের করতে হবে এবং প্রত্যেককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

মব সহিংসতা বন্ধে এবং সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকার যে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে, ভালুকার ঘটনাটি তারই ধারাবাহিকতা। নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে বারবার মব সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে সমাজের কোনো কোনো গোষ্ঠী নিজেদের অতি ক্ষমতাবান ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করায় নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

দীপু চন্দ্র দাস ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী, দেড় বছরের শিশুসন্তান এবং বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবা রয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি দিশাহারা। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব।

শুক্রবার গভীর রাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামে আগুনে পুড়ে সাত বছরের শিশু আয়েশা আক্তারের মৃত্যু ও তিনজনের দগ্ধ হওয়ার ঘটনাটিও জননিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। পরিবারটির অভিযোগ, দুর্বৃত্তরা ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ঘর মানুষের নিরাপদ আশ্রয়। গভীর রাতে ঘুমন্ত একটা পরিবারকে তালাবদ্ধ করে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া চরম নিষ্ঠুর অপরাধ। অপরাধীরা যখন ভাবতে শুরু করে অপরাধ করে তারা পার পেয়ে যাবে, কেবল তখনই এ ধরনের ভয়ংকর অপরাধ সংঘটনে তারা উৎসাহিত হতে পারে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস অবশ্য দাবি করেছে, নাশকতার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ তারা পায়নি। কিন্তু পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে অবশ্যই গভীরতর তদন্ত করে, তবেই উপসংহারে আসতে হবে। লক্ষ্মীপুরের এই ঘটনায় যারাই জড়িত থাক, তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি না হওয়াটা হতাশাজনক। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। নিরাপত্তা নিয়ে নাগরিকদের ভেঙে পড়া আস্থা মেরামত করতে হলে মব সহিংসতা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অবলম্বন করতে হবে। শুধু বিশেষ অভিযান এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সমন্বিত ও জোরালো অভিযান। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না—অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের উদ্দেশে সরকারকে সুস্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। নৃশংস অপরাধের পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।