জামালপুর শহরের চালাপাড়া এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা নদ ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের ঘটনা দেশের নদ–নদী, পরিবেশ এবং প্রশাসনিক জবাবদিহি—তিন দিক থেকেই গুরুতর উদ্বেগের কারণ। প্রথম আলোয় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসনের দ্রুত অভিযানে রাস্তা ভেঙে দেওয়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু এ ঘটনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত না হলে দখলের এই অবৈধ উদ্যোগ আরও বহুদূর এগোত।
স্থানীয় বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে নদ ভরাট করে রাস্তাটি নির্মাণ করছিলেন—এ তথ্য নতুন নয়। এলাকার অনেকেই বিষয়টি জানতেন, কিন্তু কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পাননি। এটা শুধু একজন রাজনৈতিক নেতার দাপটের গল্প নয়; বরং দীর্ঘদিনের দখলদারি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি; যেখানে নদ, খাল বা সরকারি জমির ওপর আগ্রাসন ক্ষমতাবানদের কাছে স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয়, প্রশাসনের নীরবতা এবং দখলদার গোষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিচয়—সব মিলিয়ে দখলদারি চলছে।
ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা নদ, যেটি শহরের একমাত্র পানিনিষ্কাশন পথ, সেটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণের ঘটনাতেই স্পষ্ট—স্থানীয় প্রশাসন প্রতিবেদন প্রকাশের আগে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল না। দুই জেলার সীমানা জটিলতার অজুহাত এখানে প্রায় অযৌক্তিক। পানি উন্নয়ন বোর্ড যখন আগেই লিখিতভাবে জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছিল যে নদটি ভরাট হলে শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হবে, তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিষয়টি শুধু পরিবেশগত ক্ষতির সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়; এটি সুশাসনের অভাবেরও একটি উদাহরণ। শহর রক্ষা বাঁধের রেলিং ভেঙে রাস্তাটি নির্মাণ, ফুটওভার ধ্বংস, ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু ফেলা—এসব কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যেই ঘটেছে। ফলে যে উদ্যোগটি জনস্বার্থের নামে শুরু হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছিল, সেটি বাস্তবে বালু ব্যবসা, চর দখল এবং প্রভাব বিস্তারের বহুল পরিচিত একটি কৌশলে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা স্পষ্টই বলেছেন, এটি গরিব মানুষের রাস্তা নয়; বরং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সুবিধার পথ।
মিজানুর রহমানের দাবি, তিনি নাকি প্রশাসনের সব অনুমতিপত্র নিয়েই কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এমন কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন। তাহলে প্রশাসনের দায়িত্ব, এই অবৈধ ভরাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। একটি রাস্তা ভেঙে দেওয়া সমাধানের প্রথম ধাপ; কিন্তু দখলদারির প্রবণতা রোধ করতে হলে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে।
লক্ষণীয়, শহরের বিভিন্ন অংশে দীর্ঘদিন ধরেই নদ দখলের অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় যা–ই হোক, দখলদারদের কৌশল প্রায় একই। দখলের এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে না পারলে নদ–নদী রক্ষার সরকারি পরিকল্পনা, কোটি কোটি টাকার প্রকল্প এবং পরিবেশ রক্ষার সব প্রতিশ্রুতিই ব্যর্থ হয়ে যাবে।