আট মাসের দায় কে নেবে?

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভেজাল চেতনানাশকে তিন প্রতিবন্ধী শিশুর মারা যাওয়ার ঘটনা খুবই মর্মান্তিক।

বিএসএমএমইউ সূত্রের বরাত দিয়ে প্রথম আলো জানায়, শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের শ্রবণসহায়তায় কানে কক্লিয়ার নামক বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান গলা বিভাগে ‘কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট’ নামের একটি কর্মসূচি আছে; যেখান থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের কক্লিয়ার দেওয়া হয়। শিশুদের সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার পর কানে কক্লিয়ার বসানো বা স্থাপন করা হয়। এই তিন শিশুকেও কক্লিয়ার স্থাপনের আগে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে হ্যালোথেন দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রথমজন মারা যায় গত বছরের ৯ ডিসেম্বর, দ্বিতীয়জন ১০ জানুয়ারি এবং শেষ জন ৩০ জানুয়ারি।

বিএসএমএমইউতে পরপর তিন শিশুর মৃত্যুর পর হ্যালোথেনের নমুনা বিসিএসআইআরে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এতে প্রমাণিত হয় অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধ হিসেবে ‘হ্যালোথেন’ দেওয়া হলেও তাতে হ্যালোথেনের উপাদান ছিল না। এর অর্থ ওই হ্যালোথেন ছিল ভেজাল মেশানো। অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান দেবাশিস বণিকও নমুনা পরীক্ষায় নানা ধরনের রাসায়নিক পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

গত কয়েক মাসে ঢাকার একাধিক হাসপাতালে খতনা করতে গিয়ে শিশুমৃত্যু, নারায়ণগঞ্জে টনসিল অস্ত্রোপচারের সময় একাধিক মৃত্যু ছাড়াও টাঙ্গাইলে একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব মৃত্যুর পেছনে হ্যালোথেন থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

বাংলাদেশে হ্যালোথেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই গত বছরের ১৫ জুন জানিয়ে দেয়, বিশ্বব্যাপী হ্যালোথেনের ব্যবহার কমে আসছে এবং ভবিষ্যতে হ্যালোথেনের বাণিজ্যিক ব্যবহার থাকবে না। তাই তারা হ্যালোথেন উৎপাদন ও সরবরাহের অবস্থায় আর নেই। এসিআইয়ের পক্ষ থেকে হ্যালোথেনের বিকল্প ব্যবহারের জন্য চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। চার দিন পর ১৯ জুন এসিআই কর্তৃপক্ষ সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরেকটি চিঠি দেয়, যাতে জানানো হয় হ্যালোথেন তৈরির কাঁচামালের সরবরাহ না থাকায় তাদের পক্ষে বাজারে হ্যালোথেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো এসিআই দুই দফা চিঠি দেওয়ার পর বাজারে হ্যালোথেনের কী পরিস্থিতি, কোথা থেকে সরবরাহ হচ্ছে, তা কেউ খতিয়ে দেখেনি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর পর অনেকে ধারণা করছেন, বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ, না হয় নকল বা ভেজাল হ্যালোথেন আছে। এরপরই ২৭ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক আদেশে বলেছে, সরকারি ও বেসরকারি কোনো হাসপাতালে হ্যালোথেন ব্যবহার করা যাবে না। হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন বা সেভোফ্লুরেন ব্যবহার করতে বলেছে মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সব হাসপাতালে আইসোফ্লুরেন বা সেভোফ্লুরেন ব্যবহারের উপযোগী নতুন যন্ত্র কেনা ও ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছি। বাজারে যেন হ্যালোথেন না থাকে, পাচার হয়ে যেন দেশে না ঢোকে, তার পদক্ষেপ নিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি।’

এসিআই ঔষধ উৎপাদন বন্ধ করেছে গত বছর জুন মাসে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন ও সিভিল সার্জনদের চিঠি দিল আট মাস পর। এত দিন তারা কী করেছে? ‘রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার এসেছেন’ বলে যে বাংলা প্রবাদটি আছে, সেটাই বাস্তবে প্রমাণ দিলেন ঔষধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা। বিএসএমএমইউর মতো প্রতিষ্ঠানও পরীক্ষা–নিরীক্ষা না করে এই ভেজাল চেতনানাশক কীভাবে ব্যবহার করল? পুরো বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করা হোক।