ওয়াজেদ আলীরাই আমাদের ভরসা

সম্পাদকীয়

২০১২ সালে কমলাপুর রেলস্টেশনে উচ্ছিষ্ট খাবার ভাগাভাগি করে মানুষ আর কুকুরকে খেতে দেখেছিলেন চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ী ওয়াজেদ আলী। পেশায় বই ব্যবসায়ী ওয়াজেদ সেদিনই ঠিক করেছিলেন, কখনো যদি সচ্ছল হন, অনাহারীদের জন্য কিছু করবেন। ১০ বছর পর তিনি সামর্থ্যবান হয়েছেন। ঢাকা ফাস্ট ফুড ও ময়ূরী বেকারি নামে দুটি প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। মনের ভেতর যে ইচ্ছা পুষে রেখেছিলেন, সেই ইচ্ছা পূরণ করছেন এখন।

প্রথম আলো চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ী ওয়াজেদ আলীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যদিও এলাকার লোকজন বলেছেন তিনি প্রচারবিমুখ। এতটাই প্রচারবিমুখ যে বছরের ওপর এই কর্মযজ্ঞ চালিয়ে গেলেও অনেকেই খবর পাননি। তাঁরা শুধু কৌতূহল নিয়ে দেখেছেন, এক ব্যক্তি প্রতিদিন রেলস্টেশনে এসে অনাহারী মানুষকে খাবার দিয়ে যান। আড়ালে স্বামীকে এ কাজে সমর্থন দেন তাঁর স্ত্রী সাজেদা খাতুন, মেয়ে ও মেয়ের স্বামী এবং ছেলে।

যদি কোনো দিন বাবুর্চি না আসেন, তখন ওয়াজেদ আলীর পরিবারের লোকজন রান্না করেন। এ কাজে ওয়াজেদ আলীর আরও বেশ কয়েকজন নীরব সঙ্গী আছেন। ওয়াজেদ আলীর মেয়ে শারমিন আক্তার ও জামাতা সিরাজুম মুনীর খান প্রতি মাসে এক দিনের খাবারের টাকা দেন, বেলগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম দুই দিন, ব্যবসায়ী জয়দেব কুমার এক দিনের খরচ দেন।

খাবার তৈরি ও বিতরণে আলমডাঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম, কারখানার কর্মচারী রাজু আহমেদ ও আবদুর রহমান এবং স্থানীয় মুরব্বি চতুর আলী স্বেচ্ছাশ্রম দেন। খাবার প্যাকেট তৈরিতে সাহায্য করেন আলমডাঙ্গা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস হোসেন।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এখন এক কঠিন সময় পার করছে। মূল্যস্ফীতির চাপে চিড়েচ্যাপটা মানুষ। নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা। তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বাড়তি মজুরির দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা। জ্যান্ত মানুষ পুড়ে মরছে। হরতাল–অবরোধে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ কষ্টে পড়েছেন। বড় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করেছেন। আর সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ।

এত এত অসংগতির মধ্যেও আসলে মনুষ্যত্ব, বিবেক বেঁচে থাকে। মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। করোনাকালেও আমরা দেখেছি, সামান্য সামর্থ্য নিয়েও মানুষ দুর্গত মানুষের কাছে খাবার নিয়ে, ওষুধ নিয়ে ছুটে গেছেন।

করোনায় চাকরি হারিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন অনেকে। আমাদের ওয়াজেদ আলী ও তাঁর বন্ধুরাও তেমনই। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশার বৈচিত্র্য—কোনো কিছুই তাঁদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে মেলেন। এর বিনিময়ে পান অনাথ-আতুর, প্রতিবন্ধী আর নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ দম্পতিদের মুখের হাসি। তাঁরা বলেছেন, এই হাসি স্বর্গীয়, তাঁদের কাজের অনুপ্রেরণা।