দ্বীপটি মেরে ফেলার এ আয়োজন কেন?

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, সরকারি অন্যান্য সংস্থা, হোটেল-রিসোর্ট-জাহাজ-ট্রলার ব্যবসায়ী এবং পর্যটকেরা মিলে যেভাবে মেরে ফেলার আয়োজন চলছে, তাতে লোভী ও অপরিণামদর্শী কৃষকের সোনার ডিম পাড়া হাঁসের লোকগল্পটি সবার আগে মনে আসে। অথচ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ রক্ষায় আইন, বিধিবিধান, নির্দেশনা, প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ সবই আছে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়ায় সেন্ট মার্টিনের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে, এমন কোনো কাজ সেখানে করা যাবে না। এ কারণে সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণে ছাড়পত্র দেয় না পরিবেশ অধিদপ্তর। অথচ বহুতল ও একতলা মিলিয়ে সেখানে হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা ২৩০-এর বেশি। এর মধ্যে গত দুই বছরে তৈরি হয়েছে অন্তত ১৩০টি। এখন নির্মাণকাজ চলছে ৩০টির বেশি রিসোর্ট ও কটেজের।

সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো ছাড়পত্র ছাড়াই সরকারি সংস্থা দ্বীপটিতে বাংলো, অফিসার্স মেসসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ যে স্থাপনা করেছে, সেখানে সরকারি ও পুলিশের কর্মকর্তারা গিয়ে থাকেন। পুলিশেরটি ভাড়াও দেওয়া হয়। যে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের দ্বীপটি দেখভালের দায়িত্ব, তারাই যদি আইন ও বিধিবিধানকে এভাবে বুড়ো আঙুল দেখায়, তাহলে অন্যরা কী করছে, সেটা বলা বাহুল্য।

অবাধে এভাবে পর্যটনের জন্য ছেড়ে দেওয়ায় দ্বীপটির কতটা সর্বনাশ হয়েছে, তা দেশে-বিদেশের নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে চার বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে তিন বর্গকিলোমিটারে। আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি প্রবালশূন্য হয়ে যাবে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে জমি বেচাকেনা ও স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও নানা ফন্দিফিকিরে সেটা দেদার চলছে। এর সঙ্গে জড়িতরা রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাঁরা এতটাই বেপরোয়া যে দ্বীপটির রক্ষাবর্ম কেয়াবন পুড়িয়ে অবাধে স্থাপনা তৈরি করছেন। দ্বীপের গলাচিপা থেকে দিয়ারমাথা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় কচ্ছপ ডিম পাড়ে বলে পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ। সেখানেও ৩০টির বেশি দোতলা রিসোর্ট ও কটেজ নির্মাণ করা হচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ঠেকানোর কাজটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে দ্বীপটিকে রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। অথচ সবার চোখের সামনে দ্বীপটিতে নির্মাণসামগ্রী নেওয়া হয়, নির্মাণকাজ চলে, হোটেল ও রিসোর্ট উদ্বোধন হয়, পর্যটকেরা যান, দারুণ ব্যবসা হয়—কিন্তু কেউ বাধা দেয় না। বরং একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে।

পরিবেশবিদেরা অনেক বছর ধরেই সতর্ক করে আসছেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ রক্ষা করতে হলে সবার আগে অপরিকল্পিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে যাতে নির্দিষ্ট সংখ্যকের বেশি পর্যটক দ্বীপটিতে না যেতে পারেন এবং তাঁরা যেন সেখানে রাতযাপনের সুযোগ না পান—সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া সেন্ট মার্টিনে যেসব সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো অবৈধ। এর সব কটিই উচ্ছেদ করতে হবে। নতুন করে যাতে সেখানে কেয়াবন সৃজন হয়, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দ্বীপটির স্থানীয়দের সরিয়ে অন্যত্র পুনর্বাসন করতে হবে।

শুধু কাগজে-কলমে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার স্বীকৃতি দিয়ে অমূল্য দ্বীপটি বাঁচানো সম্ভব নয়। একটা বিষয় সবার আগে মনে রাখা প্রয়োজন, আরেকটি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তৈরি করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন দ্বীপটি লোভী ও অপরিণামদর্শীদের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও যথাযথ ভূমিকা প্রয়োজন।