শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া রীতিমতো একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বছরের প্রথম দিন ঘটা করে বই উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিলেও দেশের সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে যেতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যেত। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও সেই দীর্ঘসূত্রতা থেকে গেছে। চলতি বছরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই সময়মতো তুলে দিতে তিন মাস পেরিয়ে যায়। সেই ব্যর্থতার খেসারত এখনো বহু শিক্ষার্থীকে দিতে হচ্ছে।
আগামী বছরে যেন একই ঘটনা না ঘটে, সে জন্য এবার বই ছাপানোর কাজের প্রক্রিয়া আগেভাগেই শুরু করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নভেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপিয়ে মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যও ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির (ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম) পাঠ্যবইয়ের দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ায় পুরো পরিকল্পনাই এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। অর্থাৎ সেই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তির অশনিসংকেত এবারও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
শিশুরা বছরের প্রথম প্রহরেই নতুন বইয়ের গন্ধে মেতে উঠবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এর ব্যত্যয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, আবার দরপত্র আহ্বান করে বই মুদ্রণের কাজ শেষ করতে কমপক্ষে পাঁচ মাস সময় লাগবে। ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মুদ্রণশিল্পের ব্যস্ততা এবং নোট-গাইড বইয়ের মৌসুমি চাপ যুক্ত হলে বছরের প্রথম দিনে বই বিতরণের যে রীতি জাতির গর্বের অংশ হয়ে উঠেছিল, তা ভেঙে পড়তে পারে।
এটিকে নিছক কোনো প্রশাসনিক বিলম্ব বলা যাবে না। এটি আমাদের নীতিপরিকল্পনায় দূরদৃষ্টির অভাব, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। প্রশ্ন জাগে, এত বছরের অভিজ্ঞতার পরও কেন পাঠ্যবই বিতরণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্মসূচি বারবার শেষ মুহূর্তে এসে ধাক্কা খায়?
দরপত্র বাতিলের এ ঘটনা প্রক্রিয়াগত ত্রুটির চেয়েও অনেক বেশি কিছু। বছর ঘুরে একই অজুহাত, একই অব্যবস্থাপনা, একই ব্যর্থতা! এই অবস্থার দ্রুত অবসান না ঘটালে এই ব্যর্থতা কেবল একটি বছরে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এটি রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতীক হয়ে উঠবে। এর জন্য এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি চিরতরে ভাঙতে হবে। দায়িত্বহীনতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, দরপত্র প্রক্রিয়ার সংস্কার করতে হবে। ই-প্রকিউরমেন্ট ও আন্তর্জাতিক মানের স্বচ্ছতা ছাড়া পাঠ্যবই ছাপার ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে না। তৃতীয়ত, মুদ্রণ সক্ষমতার প্রসার ঘটাতে হবে। সরকারি প্রেসে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, বেসরকারি খাতের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় গড়তে হবে। চতুর্থত, বই মুদ্রণের প্রক্রিয়াকে মৌসুমি কাজের পরিবর্তে বছরব্যাপী পরিকল্পনায় রূপান্তর করতে হবে।
সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারকে এই বার্তা দিতে হবে যে পাঠ্যবই বিতরণ শুধু একটি প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়; এটি আগামী প্রজন্মের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার যদি বারবার ভঙ্গ হয়, তবে তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি নাগরিকদের আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মননে গভীর ক্ষতের দাগ আঁকবে।
পাঠ্যবই বিতরণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবং বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দেওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারকে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। আমরা আশা করব, আগামী বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে একযোগে নতুন বই পৌঁছে যাবে।