ত্রাণ ও পুনর্বাসনকাজ জোরদার করা হোক

সম্পাদকীয়

ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে গেলেও এর প্রভাব দেশের প্রায় সব জেলাতেই পড়েছে। সরকারি হিসাবে ১৯টি জেলায় ৩৭ লাখ লোকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

ঘূর্ণিঝড়ে গাছ ভেঙে ও দেয়ালধসে ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ঢাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন ৪ জন। ঘূর্ণিঝড়ে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘর ও আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘর।

এবারে রিমালের যে ধরন তাতে হতাহতের সংখ্যা দিয়ে পুরো ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে না। দীর্ঘ সময় ধরে ঝড় ও ভারী বৃষ্টির কারণে অনেক এলাকার ফসল নষ্ট হয়েছে, ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি বড় শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ২৪ ঘণ্টা পরও অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ পুনঃ স্থাপন করা যায়নি।

একসময় উত্তরবঙ্গের মানুষ মঙ্গার কবলে ছিল। এখন উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। প্রায় প্রতিবছরই তাদের ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হতে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রাক্‌-দুর্যোগ প্রস্তুতিও মোটামুটি ভালো ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের আগে উপদ্রুত মানুষ যাতে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারে, সে জন্য উপকূলীয় জেলাগুলোতে অনেকগুলো আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। রিমালের সময়ও উপদ্রুত অঞ্চলের মানুষ আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই পেয়েছেন।

কিন্তু আশ্রয়শিবির থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁদের কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। অনেকের ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙে গেছে, অনেকের খাবার ও সুপেয় পানির আধার নষ্ট হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তাঁদের জন্য খাবার ও সুপেয় পানি সরবরাহ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে গাফিলতি লক্ষ করা যায়। ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটিও ঠিকমতো করা হয় না। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির গুরুতর অভিযোগ আছে।

রিমালের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো সুন্দরবনই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারে। আমাদের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে সুন্দরবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েক দিন আগেও সুন্দরবনে আগুন লেগে কয়েক হাজার গাছ পুড়ে যায়।

সুন্দরবনের পর মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষার প্রধান অবলম্বন উপকূলীয় বাঁধ। প্রতিবারই ঘূর্ণিঝড়ের পর বাঁধ নিয়ে কিছুটা হইচই হয়। কিন্তু বাঁধ সংস্কার ও মেরামতে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। রিমালে সাতক্ষীরা জেলার বাঁধ মোটামুটি অক্ষত থাকলেও ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা ও বাগেরহাটে বিস্তীর্ণ এলাকার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবরে এসেছে পটুয়াখালীর ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। এটা এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি সরকারের উদাসীনতাই প্রমাণ করে।

সরকার অনেক অনুৎপাদনশীল খাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, অথচ ১০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সরকার ভেঙে যাওয়া বাঁধ খুব দ্রুত মেরামত করে দেবে, এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন না। রিমালের তাণ্ডবের পর কয়রার মানুষ নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণ করেছেন।

আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সরকার ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাবে। যাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে, তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দেবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা আবার যাতে শস্য ফলাতে পারেন, মৎস্যচাষিরা যাতে আবার মাছ চাষ শুরু করতে পারেন, সে জন্য তাঁদেরও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। উপদ্রুত এলাকায় যত দ্রুত জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে, তত দ্রত সেখানকার অর্থনীতি সচল হবে।