কাস্টমসে হয়রানি কাম্য নয়

বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাস্টমস বা শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সম্পর্ক কখনো অম্ল, কখনো মধুর। কাস্টমস কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যবসায়ীরা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্য নানা রকম ফন্দিফিকির আঁটেন এবং ধরা পড়লেই কাস্টমসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা সব সময় ‘উপরি’ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন, সেটা দিলে কোনো সমস্যা হয় না। না দিলেই হয়রানি করেন।

২৮ মে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে, সেটি অবিশ্বাস্য। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একটি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা গত বছর চীন থেকে প্রায় ৯০ হাজার কেজি কাপড় আমদানির ঋণপত্র খোলে। চট্টগ্রাম বন্দরে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে ১ হাজার ৭০০ কেজি কাপড় বেশি আসায় কাস্টমস কর্মকর্তারা ওই প্রতিষ্ঠানটিকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন। একই সঙ্গে বাড়তি কাপড়ের শুল্ক বাবদ কারখানাটিকে সাড়ে চার লাখ টাকা জমাও দিতে হয়।  

বন্দর থেকে কাপড় ছাড় করাতে দেরি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করতে পারেনি এবং ৫০ শতাংশ মূল্যছাড়ে তাদের পোশাক রপ্তানি করতে হয়। ব্যবসায়ীরা এটাকে তাদের প্রতি কাস্টমসের জুলুম বলেই মনে করেন। পণ্য রপ্তানি ও কাঁচামাল আমদানিতে কাস্টমসের হয়রানির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অভিযোগ, কাস্টমস কর্মকর্তারা করের চেয়ে জরিমানা আদায়ে বেশি উৎসাহ দেখান। এ কারণে জরিমানার একটি অংশ কর্মকর্তারা পেয়ে থাকেন প্রণোদনা হিসেবে। আবার কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলে সেই জরিমানা দিতে হয় না।

ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি বন্ধ করতে জরিমানা আদায়ের বিধানটি অযৌক্তিক নয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কমিশন দিতে হবে কেন? কাজ করার জন্য তাঁরা তো বেতনই পান। যেখানে সময়ের প্রশ্ন জড়িত, সেখানে ব্যবসায়ীরা অনেকটা নিরুপায়। তাঁরা উৎকোচ দিয়ে হলেও পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণের সময়সূচি রক্ষা করতে চান।

এ ক্ষেত্রে আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে, এক হাতে তালি বাজে না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যাঁরা ১০০ টাকা কর ফাঁকির জন্য ৫০ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে তিনি যে দেশের ক্ষতি করলেন, সেটা ভাবেন না। পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি কেন কার্যকর করা হলো না? যদি কাস্টমস কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য সৎ হতো, তাঁরা অনেক আগেই অটোমেশনে যেতেন।

কাস্টমসে বিজিএমইএর সদস্যদের এক লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার মুখে পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের শীর্ষ সংগঠনটির সভাপতি। তিনি বলেছেন, আইনের মধ্যে থেকেই কাস্টমস কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছেন। এইচএস কোডে দাঁড়ি-কমা ভুল হলে কিংবা ওজন কমবেশি হলে বিশাল অঙ্কের জরিমানা নেওয়া হয়। 

চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২৩-এর উদ্যোক্তা জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী উচ্চমাত্রার দুর্নীতিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সর্বশেষ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যবসার পারিবেশের আরও অবনতি হয়েছে। 

ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হলে ব্যবসায়ীদের যেমন আইন মেনে চলতে হবে, তেমনি কাস্টমসকেও অযথা হয়রানি বন্ধ করতে হবে। পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়াটি অটোমেশন করা হোক। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের হয়রানি অনেকাংশে কমবে আশা করা যায়।