প্রতিবছর ৯০০ প্রসূতির মৃত্যু হয় শুধু অকার্যকর রেফারেল পদ্ধতির কারণে। মেটারনাল ফিটাল মেডিসিন সোসাইটি অব বাংলাদেশের (এমএফএমএসবি) আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উঠে আসা এ তথ্য আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার গলদকেই শুধু প্রকাশ করে না, সামগ্রিক দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার চিত্রও ফুটিয়ে তোলে।
রেফারেল পদ্ধতি বলতে একজন রোগীকে প্রয়োজনীয় ও উন্নত চিকিৎসার জন্য এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর প্রক্রিয়াকে বোঝায়। কিন্তু বাংলাদেশে এই পদ্ধতির কোনো সুসংহত কাঠামো নেই। চিকিৎসকেরা প্রায়ই রোগীর দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেন, কিন্তু রোগী ঠিক সময়ে ও ঠিক স্থানে পৌঁছাচ্ছে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর ফলে প্রসূতিরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং পথেই মারা যাচ্ছেন।
রেফারেল পদ্ধতির স্পষ্ট নীতিমালা বা বিধিবিধান না থাকায় রোগী পাঠানোর সময় উদ্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি, যোগাযোগের আনুষ্ঠানিকতা কিংবা জবাবদিহি থাকে না। এটি সংকটকে তীব্রতর করছে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য আহমেদ এহসানূর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘রেফারেল’-এর সর্বজনবিদিত বাংলা প্রতিশব্দ না থাকার মধ্যেই এই পদ্ধতির প্রতি সমাজ ও প্রশাসনের অস্পষ্ট ধারণা প্রতিফলিত হয়।
এ সংকটের বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। প্রথমত, উপজেলা পর্যায়ে অপর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স, দক্ষ জনবলের অভাব এবং যাতায়াত ব্যয় অনেক ক্ষেত্রে রেফারেলকে অসম্ভব করে তোলে। দ্বিতীয়ত, হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও সমন্বিত সেবার ঘাটতি থাকায় রোগী স্থানান্তরিত হলেও চিকিৎসা নিশ্চিত হয় না। তৃতীয়ত, রেফারেল পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষার অভাব চিকিৎসকদের প্রস্তুতিহীন রাখে।
এ সংকট সমাধানে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, রেফারেল পদ্ধতির জন্য একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে রোগী পাঠানো, গ্রহণ এবং চিকিৎসা প্রদানের প্রতিটি ধাপে দায়িত্ব ও প্রটোকল স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। দ্বিতীয়ত, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি যাতায়াত ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে আর্থিক সীমাবদ্ধতা কাউকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না করে। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং চিকিৎসাশিক্ষার পাঠ্যক্রমে রেফারেল ব্যবস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রেফারেল প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন, রোগীর তথ্য শেয়ারিং এবং জরুরি সেবার সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে।
এ সংকট সমাধানে একটি সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি, যেখানে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা গেলে রেফারেলের চাপ কমবে, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার।