সময় বাড়ানো-কমানোর মহড়া বন্ধ হোক

সম্পাদকীয়

আমাদের শিক্ষার অভিভাবক যাঁরা আছেন, তাঁরা বারবার সিদ্ধান্ত অদলবদল করতে পছন্দ করেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত শিক্ষক, শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে আদৌ ভূমিকা রাখছে কি না, সেসব নিয়ে তঁাদের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

সিদ্ধান্ত অদলবদলকেই তাঁরা শিক্ষার বিরাট সাফল্য বা নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করেন। এটি যেমন শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বেলায়ও।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক। আগে তাঁদের এক বছর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘোষিত শিক্ষানীতিতে এ কোর্সের মেয়াদ এক বছর থেকে বাড়িয়ে ১৮ মাস (দেড় বছর) করার কথা বলা হয়।

এরপর শিক্ষানীতির সুপারিশ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২০১২ সালে প্রথমে সাতটি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত পিটিআইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় বছর মেয়াদি কোর্স চালু করা হয়। গুরুত্ব বিবেচনা করে এ কোর্সের নাম দেওয়া হয় ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন’। ২০১৯ সাল থেকে দেশের সব কটি পিটিআইয়ে এ কোর্স শুরু করা হয়। পিটিআইগুলোর এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করছে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)।

কিন্তু গত ২২ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রম স্টিয়ারিং কমিটি’র সভায় প্রশিক্ষণের মেয়াদ ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ছয় মাস প্রশিক্ষণ হবে পিটিআইয়ে এবং বাকি চার মাসের প্রশিক্ষণকাজটি হবে মূলত বিদ্যালয়ে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, বেশি সময় শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণে থাকলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকসংকট দেখা দেয় এবং শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের নতুন মেয়াদ ১০ মাসের মধ্যে চার মাস তাঁরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন। সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণরত শিক্ষকদের দিয়েও আরও বেশি দিন পাঠদান চালানো কঠিন ছিল না। আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকসংকট নিয়ে প্রথম আলোয় সচিত্র যে খবর ছাপা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, একটি বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক না থাকায় অভিভাবকেরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে পাঠদান করছেন। স্টিয়ারিং কমিটির যে সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়, সেই সভার দুই সদস্য প্রশিক্ষণের সময় কমিয়ে আনতে অন্তত এক বছর করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেটি অগ্রাহ্য হয়ে যায়।

অতীতে আমরা দেখেছি, পূর্ববর্তী সরকারের শিক্ষানীতি পরবর্তী সরকার এসে উল্টে দেয়। কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগ সরকারের বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত শিক্ষানীতির সুপারিশগুলো আওয়ামী লীগ সরকারই একের পর এক উল্টে দিচ্ছে অথবা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকছে।

যদি শিক্ষানীতি অনুযায়ী দেড় বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ এত দিন বাহুল্য না হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কমিয়ে আনার কোনো যুক্তি নেই। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ভিত মজবুত করার জন্যই শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অতএব প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমানোর হঠকারী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হোক।

সরকার যদি শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় মনে না করে, তাহলে নিয়োগের পর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দিয়ে, নিয়োগের আগে তাঁদের নিয়োগ বা পদায়ন আবশ্যক বলে মনে করি। সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের সময় বাড়ানো-কমানোর প্রয়োজন হবে না।