দায়দেনা কেন হিসাবে ধরা হবে না

সম্পাদকীয়

পেশাগত দক্ষতা বাড়াতেই জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। কোম্পানি করার উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা। কিন্তু গত দেড় দশকে দক্ষতা বাড়ার বদলে আরও অবনতি হয়েছে। বিমান আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ রুটে অনেকগুলো বেসরকারি বিমান পরিবহন চালু হওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক রুটে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিমান ব্যবসা হারাচ্ছে না, সংস্থাটি ব্যবসা হারাচ্ছে অনিয়ম, অব্যবস্থা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণে।

সাম্প্রতিককালে বিমান পরিবহনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি যাত্রীও বেড়েছে। এরপরও বিমান চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কোনো বছর তারা লাভের মুখ দেখে, কোনো বছর লোকসান গুনতে হয়। আবার বিমান যে লাভের হিসাব দেয়, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লাভ করেছে বলে দাবি করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কাছে দেওয়া বাণিজ্যিক নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, এয়ারলাইনস-বহির্ভূত বিমানের সাবসিডিয়ারি কোম্পানির (নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান) ব্যবসায় যে লাভ হচ্ছে, সেটাই বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখাচ্ছে। উল্লিখিত বছরে বিমানের মূল ব্যবসায় (যাত্রী ও পণ্য পরিবহন) ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

বাণিজ্যিক হিসাব নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, ল্যান্ডিং চার্জ, বোর্ডিং চার্জ, ইজারা, সারচার্জ এবং বিভিন্ন চার্জের ওপরে ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ বিমানের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাদের আর্থিক বিবরণীতে সেটি দেখানো হয়নি। দেখানো হয়নি পদ্মা অয়েল কোম্পানির কাছে বিলম্বিত জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ সুদ বাবদ বিপুল বকেয়াও।

বিমান ২৩টি আন্তর্জাতিক ও ৮টি অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনসেবা দিয়ে থাকে। তবে এর বাইরেও বিমান হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও কার্গো হ্যান্ডলিং সেবা, বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার, বিমান পোলট্রি কমপ্লেক্স আছে। এসব সরাসরি এয়ারলাইনসের ব্যবসা না হলেও বিমান সেটিকে তাদের আয় হিসেবে দেখাচ্ছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী উল্লিখিত বছরে বিমানের যে অপারেটিভ আয় হয়েছে, তার মধ্যে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সার্ভিস চার্জ বাবদ আয়ের পরিমাণ হলো ১ হাজার ২০৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকার বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের দাবি করা সারচার্জ ও অন্যান্য মাশুলের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা, যা বিমানের দায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। এসব দায় দেখানো হলে বিমানের লোকসানের পাল্লাই ভারী হবে।

এটা এক ধরনের শুভংকরের ফাঁকি। অন্যান্য বিমান পরিবহন যদি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে লাভ করতে পারে, বিমান পারবে না কেন? প্রতিষ্ঠানটিকে কেন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সেবার আয় যোগ করতে হবে? বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিউল আজিম অবশ্য বিমানের লাভের হিসাবকে যৌক্তিক মনে করেন। তাঁর মতে, ওই দুটি সেবাও বিমানের। কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বিমানের কাছে কত টাকা পাবে, সেটা তারা প্রকাশ করছে না কেন?

বেসরকারি বা বিদেশি বিমান পরিবহন যেভাবে বিমানবন্দরের সেবার জন্য মাশুল দিয়ে থাকে, বিমানকেও সেভাবে দিতে হবে। একই মন্ত্রণালয়ের হলেও দুটি প্রতিষ্ঠান আলাদা। কইয়ের তেলে কই ভাজার নীতি থেকে সরে এসে বিমানের উচিত হবে সেবার মান বাড়িয়ে যাত্রীদের আকৃষ্ট করা।