সাইবার নিরাপত্তা আইন: পুলিশের হাতেই অগাধ ক্ষমতা থেকে গেল

সম্পাদকীয়

বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও গত বুধবার সরকার জাতীয় সংসদে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ পাস করেছে। আইনটি পাসের সঙ্গে সঙ্গে ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হয়ে গেল।

প্রশ্ন হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ বিভিন্ন মহলের যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিল, নতুন আইনে সেটি প্রশমিত হবে কি না।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ছিল পুরোপুরি নিবর্তনমূলক। সরকারের পক্ষ থেকে যদিও এই আইনের পক্ষে ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ দমনের কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই এটি বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। দেশে-বিদেশে আইনটি নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনা হয়। এমনকি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন আইনের দুটি ধারা বাতিল ও কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল।

সাইবার নিরাপত্তা আইনটি পাসের আগে সরকার অংশীজনদের কথা শুনলেও উদ্বেগের দিকগুলো বিবেচনার বাইরেই থেকে গেছে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা একে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ বলে অভিহিত করেছেন। নতুন আইনে পুরোনো আইনের ১৪টি অজামিনযোগ্য ধারার মধ্যে ১০টি নতুন আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে।

অনেক ধারায় শাস্তির মেয়াদ ও মাত্রা কমানো হয়েছে। এটি ভালো দিক। কিন্তু আইনটি নিয়ে সাংবাদিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদের মূল যে উদ্বেগ ছিল, অপরাধের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট না করা এবং বিনা পরোয়ানায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, তাঁর বাড়ি বা স্থাপনায় তল্লাশি চালানো—সেটা অবিকল রেখে দেওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ডিজিটাল মাধ্যমে সংবাদসংক্রান্ত কোনো অভিযোগ এলে সেটি প্রেস কাউন্সিলে পাঠানোর বিধান রাখা হোক। কিন্তু সরকার সেটি আমলে নেয়নি।

আইনে বলা আছে, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ করলে বা করালে তাঁর সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নামে অনেক নিরীহ মানুষকে জেল–জুলুমের শিকার হতে হয়েছে।

আইনে বর্ণিত ধর্মীয় মূল্যবোধ কিংবা অনুভূতিতে আঘাত হানার বিষয়টি কে নির্ধারণ করবে? একই কথা প্রযোজ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়েও। এই আইনের সবচেয়ে বিপদের দিক হলো পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিস ও দেহ তল্লাশি, পরোয়ানা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া।

সংবাদমাধ্যমের অংশীজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাইবার নিরাপত্তা আইন থেকে ৩২ ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের এই আইন তো অন্য আইনে জারি আছে। আমরা আইনটি পুরোপুরি বাতিলের দাবি করছি।

কেবল সংবাদক্ষেত্র নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছিল। নতুন আইনেও সেই আশঙ্কা থেকে গেল। এই আইনে কেউ ভিত্তিহীন মামলা করলে তার শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মামলাটি যে ভিত্তিহীন, সেটা প্রমাণের আগেই তো ভুক্তভোগীকে অযথা হয়রানির শিকার হতে হবে। 

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হলেও এই আইনের মামলাগুলো চলবে। ক্ষতিপূরণের প্রশ্নই আসে না। এর পক্ষে তিনি সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো বাতিল হওয়া আইনে ইতিমধ্যে যঁারা হয়রানিমূলক কারাভোগ করেছেন, তাঁরা কেন ক্ষতিপূরণ পাবেন না? একজন নিরপরাধ ব্যক্তি কোনো অবস্থায়ই শাস্তি পেতে পারেন না।