বিশ্বজুড়ে ক্রীড়াচর্চায় বিভিন্ন দেশের যে বহুমুখী অংশগ্রহণ, সে তুলনায় নিঃসন্দেহে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। একসময় এলাকায় এলাকায় যে ক্রীড়া সংগঠকেরা ছিলেন, যাঁদের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে অনেক খেলোয়াড় উঠে আসতেন জাতীয় পর্যায়ে, সেই ধারাবাহিকতায় ভাটা পড়েছে অনেক আগেই। তবে কুমিল্লার দাউদকান্দির রবিউল করিমদের মতো কিছু ব্যক্তি ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র মতো কাজটি করে যাচ্ছেন। বিষয়টি অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক।
দাউদকান্দির মাইথারকান্দি গ্রামের বাসিন্দা রবিউল করিমের স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের ফুটবলার হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরির কাজে নিজেকে যুক্ত করেছেন তিনি। স্থানীয় একটি স্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক তিনি। তবে বিনা মূল্যে তিনি আগ্রহী ব্যক্তিদের ফুটবল, কাবাডি ও কারাতে শিখিয়ে যাচ্ছেন। ‘লিয়ন স্যার’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত তিনি। তাঁর অধীন বর্তমানে ২০০ খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সপ্তাহে চার দিন তিনি স্থানীয় একটি মাঠে প্রশিক্ষণ দেন। কুমিল্লার দাউদকান্দি, তিতাস, হোমনা ও মেঘনা; চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ, মতলব উত্তর ও কচুয়া থেকে আগ্রহী ব্যক্তিরা তাঁর কাছে শিখতে আসেন। এভাবে গত ১৮ বছরে তিনি ৫ হাজার ৪০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলে জানান।
রবিউল করিমের কাছ থেকে ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ক্লাবে খেলছেন অনেকে। ফুটবল লীগে তাঁর ছাত্ররা অনেক সাফল্যও কুড়িয়েছেন। ফুটবলের কলাকৌশল শেখানোর পাশাপাশি কাবাডির প্রশিক্ষণও দেন রবিউল। গৌরীপুরের একটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তাঁর প্রচেষ্টায় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় বড় সাফল্য এনে দিয়েছে। বিদ্যালয়টির এক ছাত্রী জাতীয় পর্যায়ে কাবাডি খেলায় প্রশিক্ষণেরও সুযোগ পায়। রবিউল করিম কারাতের ব্ল্যাক বেল্টধারী। অনেক ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছ থেকে কারাতে শিখেছে। কয়েকজন ব্ল্যাক বেল্টও অর্জন করেছে। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, ‘লিয়ন স্যার বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দেন। দরিদ্র খেলোয়াড়দের নিজের টাকায় ক্রীড়াসামগ্রী কিনে দেন। এমন খেলাপাগল মানুষ আর দেখিনি।’
আমাদের গ্রামগঞ্জ বা মফস্সলে একসময় এমন অনেক রবিউল ছিলেন, এখনো আছেন, তবে তাঁদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। জাতীয় পর্যায়ে সব ধরনের খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতার জীর্ণদশার রেশ স্বাভাবিকভাবে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। আর পরিবার ও সমাজে খেলাধুলার গুরুত্ব যে দিন দিন কমছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গ্রাম কিংবা শহর—খেলার মাঠই–বা কোথায়? ফলে রবিউলদের সংখ্যাও কমছে। এমন বাস্তবতায় একজন রবিউল বা লিয়ন স্যার দাউদকান্দির একটি গ্রামে বসে যেভাবে ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্রীড়ামুখী করছেন, স্থানীয়ভাবে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর মতো আরও ক্রীড়া সংগঠক ও প্রশিক্ষক গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠুক। আমরা রবিউলকে সাধুবাদ জানাই।