আলোচনা করে সমাধানই উত্তম পথ

সম্পাদকীয়

নভেম্বর ও ডিসেম্বর—শিক্ষাবর্ষ সমাপন ও বার্ষিক পরীক্ষার সময়কালটা শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অভিভাবকদের জন্যও উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। সারা বছর পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যে মানসিক পীড়ায় থাকতে হয়, তা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও সেটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বার্ষিক পরীক্ষার মৌসুমে শিক্ষকদের কর্মবিরতি, শাটডাউনের মতো কর্মসূচি যারপরনাই বিস্ময়কর ও দুঃখজনক।

গত সোমবার চার দফা দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কর্মবিরতি শুরু করেন। এ কর্মসূচির কারণে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের ৬৩১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গত সোম ও মঙ্গলবার বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বিদ্যালয়ে গিয়েও ফিরে আসে। দুই দিন পর মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা কর্মবিরতি সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সোমবার পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি শুরু করেন। বৃহস্পতিবার দেশের অনেক জায়গায় বিদ্যালয়ের গেটে তালা লাগিয়ে শিক্ষকেরা শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেছেন। ফলে চতুর্থ দিনের মতো অনেক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।

পেশাগত বঞ্চনাবোধ থাকলে শিক্ষকেরা সরকারের কাছে তাঁদের দাবিদাওয়া জানাতেই পারেন, নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিও পালন করতে পারেন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে যে কর্মসূচি তাঁরা দিয়েছেন, নৈতিকতার বিচারে তা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ আবার চূড়ান্তভাবে অগ্রহণযোগ্য। বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষকদের ধর্মঘট ও কর্মবিরতি খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

অতীতে দেশের নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্মসূচি দিতে আমরা দেখেছি। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামেন। সড়ক আটকে নাগরিকদের জিম্মি করে অনেক গোষ্ঠী দাবি আদায়ের পথ বেছে নেয়। কেউই দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো ভাবেননি বলেই প্রতীয়মান হয়। শিক্ষকদের কাছে নাগরিকদের প্রত্যাশার জায়গাটা অনেক উঁচু আর সবার মতো তাঁরা যদি একই কৌশল বেছে নেন, তাতে তাঁদের সামাজিক মর্যাদাটাও অনেকখানি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করোনা মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে এমনিতেই শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে। নতুন করে তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়, এমন কর্মসূচি যেকোনো বিচারে দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই পরিচায়ক। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের শিক্ষকেরা নানা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন–ভাতা ও সুযোগ–সুবিধা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু শিক্ষকদের এ বাস্তবতাও অনুধাবন করা প্রয়োজন যে তাঁরা যে বঞ্চনার কথা বলছেন, সেটা দীর্ঘদিনে পুঞ্জীভূত হয়েছে।

মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে দাবিদাওয়া তুলেছেন, সরকারকে অবশ্যই তা পর্যালোচনা করে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, অচলাবস্থায় একমাত্র ক্ষতি বাড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। সরকারকেও মনে রাখা প্রয়োজন যে কঠোর কোনো পদক্ষেপে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

শিক্ষকদের অবশ্যই শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁদের যে মূল দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা, তা সবার আগে পালন করতে হবে এবং শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষাকেন্দ্রে ফিরে যেতে হবে। বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রেখে তাঁরা যে কর্মবিরতি পালন করেছেন, সেটি ভুল ও অযৌক্তিক পথ। শিক্ষকেরা গতকাল রাতে কর্মসূচি স্থগিত করেছেন, এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির আগে আলোচনা করে সমাধান করাই হবে যুক্তিসংগত।