বাফুফে সভাপতির দায় স্বীকারই কি যথেষ্ট

সাফজয়ী নারী ফুটবল দলকে অলিম্পিকের বাছাইয়ে খেলতে যেতে না দিতে পারার ব্যর্থতার মধ্যেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) নতুন কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়েছে। আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ এনে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে সব ধরনের ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও এ ঘটনা সামগ্রিকভাবে বাফুফের কর্মকাণ্ডকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার এ দায় সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনসহ বাফুফের কর্তাব্যক্তিরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ফিফার নৈতিকতাবিষয়ক কমিটির ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানি কার্যক্রম শেষে বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। ফিফার ওয়েবসাইটে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে ৫১ পৃষ্ঠার একটি নথি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ফিফা চারটি ধারায় অভিযোগ আনে। সেগুলো হলো ধারা-১৫ (সাধারণ কর্তব্য), ধারা-১৩ (আনুগত্যের দায়িত্ব), ধারা-২৪ (জালিয়াতি ও মিথ্যাচার), ধারা-২৮ (তহবিল তছরুপ ও অপব্যবহার)। এর মধ্যে প্রথম তিনটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিফার স্বাধীন নৈতিকতাবিষয়ক কমিটির বিচারিক চেম্বার।

আবু নাঈম সোহাগের বিরুদ্ধে যেসব অনিয়মের অভিযোগে শাস্তি হয়েছে, সেগুলো ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সংঘটিত ঘটনা। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। গত বছরের অক্টোবরে প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ফিফার সদর দপ্তরে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে সোহাগ ও তঁার পক্ষে চারজন আইনজীবী অংশ নেন।

ফিফা তাদের তদন্তে পেয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে দেওয়া ফরোয়ার্ড ফান্ডের অর্থের অপব্যবহার করা হয়েছে। এই ফান্ডের টাকা নির্দিষ্ট খাতে খরচের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানা হয়নি। নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে তহবিলের টাকা রাখা ও লেনদেনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তার ব্যত্যয় হয়েছে। ফিফার নৈতিকতাবিষয়ক কমিটির তদন্ত দল বেশ কিছু লেনদেন বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার আর্থিক অসংগতি খুঁজে পেয়েছে, যা মোট যাচাইকৃত লেনদেনের ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এ ছাড়া কেনাকাটার ক্ষেত্রে চারটি অসংগতি পেয়েছে তারা। এর মধ্যে একই উৎস থেকে দরপত্র আহ্বান ও চালান ছাড়াই অর্থ পরিশোধের মতো অভিযোগ রয়েছে।

সব ধরনের ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিবৃতি দিয়ে আবু নাঈম সোহাগের আইনজীবী দাবি করেছেন, ফিফার রায় ‘ত্রুটিপূর্ণ’, ‘অনুমাননির্ভর’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘পক্ষপাতদুষ্ট’। বিবৃতিতে আরও দাবি করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ফুটবলকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এ রায় দেওয়া হয়েছে’। বিবৃতির এ ভাষ্য শুধু হাস্যকরই নয়, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব সামনে এনে গুরুতর অভিযোগকে লঘু করার চিরাচরিত প্রচেষ্টা। প্রশ্ন হলো, বাফুফেকে লক্ষ্যবস্তু বানানোয় ফিফার লাভটা কী?

আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে আপিল করার সুযোগ রয়েছে আবু নাঈম সোহাগের। কিন্তু এ ঘটনা ধরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার যে উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এল, তা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। সরকার, বিশেষ করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে এ ঘটনায় যথাযথ নজর দিতে হবে এবং স্বাধীন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে অভিযোগগুলো তদন্ত করতে হবে।

ফিফার সিদ্ধান্তের পর বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আবু নাঈম সোহাগকে বাদ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কার্যনির্বাহী পরিষদ আনুষ্ঠানিক সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বলেছেন, ‘এ ঘটনার দায় আমাকেই নিতে হবে’। দায় তাঁকে অবশ্যই নিতে হবে। কারণ, সভাপতি হিসেবে বাফুফে কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, কোথায় কী অনিয়ম হচ্ছে, তা নজরদারি করাই তাঁর কাজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সভাপতি হিসেবে প্রশাসনিক এই ব্যর্থতা শুধু দায় স্বীকার করেই কি এড়াতে পারেন কাজী সালাউদ্দিন। তাঁর এ পদ ধরে রাখার আর কোনো যৌক্তিকতা আছে কি?

দেশের অন্যান্য ক্রীড়া ফেডারেশনের বিরুদ্ধেও নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা ও অগণতান্ত্রিকভাবে সংগঠন পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। সবকিছু ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই।