হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় এড়াবে কীভাবে

সম্পাদকীয়

যে হাসপাতালে রোগীরা আরোগ্য লাভের জন্য আসেন, সেই হাসপাতালেই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত মমতাজ বেগম নামের এক নারী লিফটে আটকে পড়ে মারা গেলেন! তিনি সেখানে চিকিৎসাসেবা পাওয়ারও সুযোগ পেলেন না।

পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, বুকে ব্যথা নিয়ে গত রোববার সকালে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন মমতাজ বেগম। বেলা পৌনে ১১টার দিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই বিভাগের চিকিৎসকেরা তাঁকে চারতলায় হৃদ্‌রোগ বিভাগের সিসিইউতে পাঠান। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নিয়ে দ্রুত লিফটে ওঠেন। কিন্তু লিফট নয়তলার মাঝামাঝি নামতেই বন্ধ হয়ে যায়। ৪৫ মিনিট ধরে বন্ধ থাকা লিফটে রোগী মারা যান।

মমতাজ বেগমের মেয়ে শারমিন আক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁরা লিফটের ভেতরে থাকা তিনটি ফোন নম্বর থেকে লিফটম্যানদের ফোন করলেও তাঁরা উদ্ধারের চেষ্টা করেননি। বরং তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এ অবস্থায় রোগীর স্বজনেরা জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করলে অগ্নিনির্বাপণ দল এসে তাঁদের উদ্ধার করে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেওয়া চিঠিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘লিফটে আটকে পড়া রোগীসহ লোকজন দরজা ধাক্কাধাক্কি করায় লিফটের দরজার নিরাপত্তাব্যবস্থা কাজ করেনি। লিফটে রোগীসহ অন্যরা ৪৫ মিনিট নয়, মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট আটকে ছিলেন।’

প্রথমেই প্রশ্ন আসে, হাসপাতালের মতো অতি জরুরি প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি লিফটে লিফটম্যান থাকবে না কেন? হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনদের অনেকেই লিফট ব্যবহার করতে জানেন না। হাসপাতালের লিফটম্যানদের কেবল বাইরে থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়ে থাকলে সেটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া কিছু নয়। হাসপাতালের লিফটম্যানের দায়িত্ব ভাড়ায় চালিত যানবাহনের চালকের মতো হতে পারে না যে টেলিফোন করলে আসবেন, না করলে বাইরে থাকবেন। যেকোনো হাসপাতালে প্রতিটি লিফটের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লিফটম্যান থাকতে হবে।

রোগীর স্বামীর অভিযোগ, তিনি লিফট খোলার জন্য কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে ধরনা দিয়েও সহায়তা পাননি। কর্মকর্তারা লিফট চালু করতে না পারুন, লিফটম্যানদের তো খুঁজে বের করতে পারতেন। ভেতরের লোকজন ধাক্কাধাক্কি করায় লিফট খোলা যায়নি বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে সাফাই গেয়েছে, সেটাও অগ্রহণযোগ্য। আটকে পড়া লোকজন যখন ভেতর থেকে লিফটম্যানদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তখন কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাছে এ বার্তা দিল না কেন?

লিফটে কেবল মারা যাওয়া রোগীর স্বজনেরা ছিলেন না, আরও মানুষ ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই সাংবাদিকেরা আটকে পড়া সময়কালটা জেনেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ডও সাংবাদিকদের কাছে আছে। অতএব, সংবাদমাধ্যমের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করা যাবে না। এ হাসপাতালেই ৩ মে ১২ তলার দেয়ালের পাশের ফাঁকা স্থানে পা ফসকে পড়ে এক রোগী মারা যান। হাসপাতালে এ রকম ফাঁকা স্থান থাকার কথা নয়।

লিফটে আটকে রোগী মারা যাওয়ার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লিফট পরিচালনার ক্ষেত্রে এতটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে, তাদের গঠিত তদন্ত কমিটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে তদন্ত করা হোক। কোনো তদন্তই মৃত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তবে সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে হাসপাতালে এ ধরনের দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে আশা করি।