চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী এখন আর প্রাণচঞ্চল নেই। বরং মানুষের লোভ আর অবহেলার শিকার হয়ে এটি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, নদীটি এখন শুধু দখল আর দূষণের শিকার নয়, এর পানি ও পলিতে মিশে গেছে ভয়ংকর মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা, যা নদীর জীববৈচিত্র্য তো বটেই, মানুষের স্বাস্থ্যকেও সরাসরি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে এক ভয়াবহ চিত্র। প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য এই নদীতে ফেলা হচ্ছে। শিল্পকারখানা, গৃহস্থালি এবং বাণিজ্যিক বর্জ্যের সঙ্গে মিশে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো (যা পাঁচ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট) এখন নদীর গভীরে প্রবেশ করেছে। এ ক্ষতিকর কণাগুলো মাছ, কাঁকড়া ও শামুকের মতো জলজ প্রাণীর দেহে প্রবেশ করছে। শেষ পর্যন্ত এই বিষাক্ত কণাগুলো খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও পৌঁছাচ্ছে, যা আমাদের জন্য এক চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নদীর তলানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব পৃষ্ঠজলের চেয়ে অনেক বেশি এবং শীতকালে এই দূষণের মাত্রা আরও গুরুতর হয়। পোশাক কারখানার বর্জ্য এবং পরিত্যক্ত মাছ ধরার জাল থেকে উৎপন্ন তন্তু আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিকই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। এই দূষণ শুধু কর্ণফুলীতে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং তা সাগরে ছড়িয়ে পড়ে সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্যকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
প্রশ্ন হলো কেন এমন হচ্ছে? কারণগুলো স্পষ্ট, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্লাস্টিক যত্রতত্র ফেলার প্রবণতা এবং ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নদী দখলের ভয়ংকর চিত্র। রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও প্রভাবশালীরা নদীর দুই পাড় দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও উচ্ছেদ অভিযান বারবার থেমে গেছে। ফলস্বরূপ, নদীর প্রস্থ কমে এসেছে আর এর অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
আমরা প্রায়ই বলি কর্ণফুলী চট্টগ্রামের প্রাণ, কিন্তু এই প্রাণকে আমরাই ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছি। চট্টগ্রাম ওয়াসা এই নদী থেকে পানি সরবরাহ করে, কিন্তু সেই পানি মাইক্রোপ্লাস্টিকমুক্ত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদি এই পানি পুরোপুরি নিরাপদ না হয়, তবে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে।
কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হলে আর বসে থাকার সময় নেই। কেবল গবেষণা আর আলোচনা যথেষ্ট নয়। প্রশাসনিক গাফিলতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব—এই দুই দিককে কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। নদী দখলকারী এবং দূষণকারী চক্রকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা জরুরি। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত এবং কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সর্বসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্লাস্টিক ব্যবহার কমানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে।