মূল্যবান পুঁথিসম্পদ রক্ষা করুন

সম্পাদকীয়

নির্মম সত্য হলো, দেশে লাইব্রেরি বা পাঠাগারের আবেদন এখন বিলীয়মান। গত এক দশকে দেশের কত লাইব্রেরি যে বন্ধ হয়ে গেছে, অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না, এমন অমূল্য কত শত বই যে কেজি দরে বিক্রি করে ঠোঙাশিল্পে উৎসর্গ করা হয়েছে, তার কোনো লেখাজোখা নেই।

তারপরও পাঠাগার বা লাইব্রেরি বলে যা অবশিষ্ট আছে, তাকে ঠিক ‘আছে’ না বলে ‘টিকে আছে’ বলাই বিধেয়। যেগুলো টিকে আছে, তা মূলত চলে সরকারি তত্ত্বাবধানে। কিন্তু যে লাইব্রেরিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়ন নেই, যে পুস্তকাগার এখন তত্ত্বাবধানহীন, তা এখন আক্ষরিক অর্থে ধ্বংসের মুখে।

প্রথম আলোর খবরে দেখা যাচ্ছে, ঠিক সেই দশায় পড়েছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মহেশাঙ্গনের রামমালা পাঠাগার। সমৃদ্ধ সংগ্রহ থাকতেও শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবে পুরোপুরি নষ্ট হতে চলেছে দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। গ্রন্থাগারের সংগ্রহে থাকা আট হাজার পুঁথির ভেতর অধিকাংশ সংস্কৃত ভাষায় লেখা।

এখানে আছে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র বা বাঁধাই করা বিশ্বভারতীর সংখ্যা। আছে ম্যাক্স মুলার সম্পাদিত স্যাক্রেড বুক অব দ্য ইস্ট-এর ৫০ খণ্ডের প্রথম সংস্করণ। চিত্রবন্ধ কাব্যপুঁথি (ছবি এঁকে লেখা পুঁথি) সম্ভবত এই একটি সংগ্রহশালায় পাওয়া যাবে বাংলাদেশে। এর মধ্যে আছে ধর্মতত্ত্ব, কাব্য, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি।

অথচ শতবর্ষী এ পাঠাগার পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে চার মাস ধরে। কবে খুলবে, কেউ জানে না। মহেশাঙ্গন ট্রাস্ট পাঠাগারটির দেখভালের দায়িত্বে। ট্রাস্টের চুক্তির শর্তের বাধ্যবাধকতার কারণে এটি সরকারি সহযোগিতা নিতে পারে না। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের আয় নেই, লোকবল নেই।

ফলে তালাবদ্ধ অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে এমন সব বই, যেগুলো আর কখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘লাইব্রেরী’ প্রবন্ধে ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে’ বলে যে পুঁথি-পুস্তকমুখর পাঠাগারের বর্ণনা দিয়েছিলেন, তার সবটাই এখানে বিদ্যমান।

অথচ শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবে এমন একটি ঐতিহ্য অবলুপ্তির কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি সার্বিক বিবেচনায় অতি লজ্জাকর। সংস্কৃতি ও শিক্ষার গৌরব বিবেচনায় নিয়ে এটিকে বাঁচানো জরুরি।

এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের দায় সবচেয়ে বেশি। পাঠাগারটির পরিচালনায় নিয়োজিত ট্রাস্টের শর্ত যদি সরকারি দায় পূরণের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বিকল্প কী উপায়ে পাঠাগারটিকে রক্ষা করা যেতে পারে, প্রয়োজনে তা খুঁজে দেখতে হবে। সেই বিকল্প অন্বেষণের দায়ও প্রধানত সরকারের।