স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হতে হবে

সম্পাদকীয়

যেকোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী তাঁর বিচার করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু বিচারের আগেই যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ‘বিচার’ করেন, তার প্রতিকার কী।

যশোরের অভয়নগর উপজেলায় পুলিশি হেফাজতে আফরোজা বেগম নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের আবদুল জলিল মোল্লার স্ত্রী। রোববার বেলা ১১টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। আগের দিন রাত দেড়টার দিকে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রাম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়া হয়েছিল।

আফরোজা বেগমের এক ছেলের অভিযোগ, তাঁর মাকে পুলিশ মারধর করেছে। চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে তাঁর মাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। অন্যদিকে পুলিশের দাবি, আফরোজা বেগমের বাড়িতে ৩০টি ইয়াবা বড়ি পাওয়া গেছে। কারও কাছে ইয়াবা বড়ি পেলেই তাঁকে মেরে ফেলতে হবে? দেশে আইন-আদালত বলে কি কিছু নেই?

এ কথা ঠিক, ইয়াবার মতো মাদক সমাজকে ধ্বংস করছে। এর ব্যবসা ও সেবন পুরোপুরি নির্মূল হোক, সেটা আমাদেরও কাম্য। কিন্তু সেটি করতে হবে আইনি উপায়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন এবং বিচার করেন, তাহলে আদালত কেন?

পুলিশের ভাষ্য সঠিক ধরে নিয়েও যে প্রশ্নটি করতে চাই তা হলো একজন নারী ইয়াবা বড়িসহ ধরা পড়ার ৯ ঘণ্টা পর কেন পুলিশি হেফাজতে মারা যাবেন? পুলিশ সদস্যরা বলেছেন, তিনি থানা হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন নারীকে কেন রাত একটায় থানায় ধরে আনতে হবে? সকাল পর্যন্ত পুলিশ অপেক্ষা করল না কেন? তা ছাড়া তিনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হলো না কেন?

গত মে মাসে নেত্রকোনার নান্দাইলে সুরাইয়া বেগম নামের এক নারী মারা যান র‍্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পে থাকা অবস্থায়। তিনি পুত্রবধূ হত্যা মামলার আসামি। গত বছর নওগাঁয় র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিন।

গত এপ্রিল মাসে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে পুলিশি হেফাজতে উপজেলা যুবদলের সাবেক এক নেতার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের দাবি, আটকের পর থানা থেকে আদালতে পাঠানোর সময় পথে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়।

আইন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনী যেকোনো অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, অভিযুক্তকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যাবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা অনেকটা কমে এসেছিল। সাম্প্রতিক কালে পুলিশ ও র‍্যাব হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া উদ্বেগজনকই বটে। গত বছর মার্চে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের (এইচআরএফবি) তথ্য অনুযায়ী, আগের সাড়ে চার বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ৭৯১টি। এর মধ্যে ২১ জন নিহত হয়েছেন পুলিশি হেফাজতে।

এসব ঘটনায় পুলিশ ও র‍্যাব যে বয়ান দেয়, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? অভয়নগরের ঘটনায় যশোর জেলা পুলিশ তিন সদস্যের যে কমিটি গঠন করেছে, তার ওপর বিশ্বাস রাখা কঠিন। পুলিশই যদি পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করে, তাতে সত্য বেরিয়ে আসবে না। পুলিশ ও র‍্যাবের হেফাজতে যতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তার স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।