এই অনাচার এখনই বন্ধ করুন

সম্পাদকীয়

বনজীবী বা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছেই সুরক্ষিত বন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁরা জীবন-জীবিকার জন্য বনের সম্পদ আহরণ করার ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে বন মিশে থাকায় তাঁরা ভালো করেই জানেন প্রকৃতিমাতা বনকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখতে হয়। বন আর তার বাসিন্দাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক জৈবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

কিন্তু মুনাফালোভীদের চোখ যখন সেখানে পড়ে, তখন আর সেই স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে না। কৃষকের সোনার ডিম পাড়া হাঁসের উপকথাটিই সত্য হয়ে ওঠে। যে হাঁসটিই কৃষককে এত দিন বাঁচিয়ে রেখেছে, সেটিকেই তখন হত্যার আয়োজন চলে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ মহাপ্রাণ সুন্দরবনের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটতে দেখছি।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সুন্দরবনের খালগুলোয় মাছ শিকারের জন্য হরেদরে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। স্থানীয় জেলেরা এর নাম দিয়েছেন ‘পানিপড়া’। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ‘পানিপড়া’ বা বিষ না প্রয়োগ করলে যথেষ্ট পরিমাণ মাছের দেখা মিলছে না। বিষ দেওয়ার ফলে ছানা, পোনা, ডিমসহ ঝাড়ে-বংশে সব মাছই মারা পড়ছে। বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে সাপ, ব্যাঙসহ জলজ প্রাণী। এসব প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল বনের অন্য প্রাণীদের ওপরও তার প্রভাব পড়ছে।

বিষ দিয়ে মাছ মারার কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা অপূরণীয়। কিছু মানুষের মুনাফার প্রতি অতিরিক্ত লোভই বনের সর্বনাশ করে চলেছে। যাঁরা সেই মাছ খাচ্ছেন, তাঁরা কি বিষের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে পারছেন? ওই অঞ্চলের মানুষ এখন পারতপক্ষে সুন্দরবন থেকে ধরা মাছ খান না।

পাঁচ বছর ধরে বনের প্রাণপ্রকৃতি হত্যার এই নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে চলেছে। বন বিভাগ ও মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে প্রশাসনের অভিযানে ২৯৩টি নৌকা ও সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা ৩ হাজার ৬৬০ কেজি মাছ জব্দ করা হয়েছে। ২১৬টি মামলা ও ২২৪ জন জেলেকে আটক করা হয়।

কিন্তু এরপরও ভয়াবহ এই অপরাধ কমছে না। কারণ, সুন্দরবনের জেলেরা দাদনের ফাঁদে বন্দী। অসাধু ব্যবসায়ীরা জেলেদের বাধ্য করেন কিংবা ফাঁদে ফেলেন বিষ দিয়ে মাছ ধরার জন্য। বনের রক্ষকদের কেউ কেউ ঘুষ নিয়ে এই অপরাধের সুযোগ করে দেন।

সুন্দরবনের জলজ প্রকৃতি কতটা নাজুক, তা কয়রার জেলে ময়জুদ্দিন মোড়লের বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ৫২ বছর ধরে সুন্দরবনের খালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। তাঁর শঙ্কা হলো, ‘আমার জীবন তো কাইটে গেল, ছাওয়ালগের কী হবি?’

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জরুরি স্বার্থে সুন্দরবনের খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার এই অনাচার বন্ধ করতে হবে।