নির্বাচন কমিশন থাকতে ‘পরিচয়’ কেন

সম্পাদকীয়

সরকারি প্রতিষ্ঠানই নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য কতটা জানতে চাইতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির নির্দিষ্ট তথ্য চাইতে পারে। কিন্তু সেই তথ্যের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সতর্কতা জরুরি।

এই প্রেক্ষাপটে ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা পাইয়ে দিতে সরকারি চাপ’ শিরোনামে প্রথম আলোয় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটা খুবই উদ্বেগজনক। বিটিআরসি ‘পরিচয়’ নামের একটি সেবা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে গ্রাহক ফরম পূরণের জন্য বারবার চিঠি দিয়েছে মোবাইল অপারেটরদের।

গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণে অপারেটরদের তথ্যভান্ডার তৈরি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে অপারেটরদের আপত্তি আছে। তারা জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যভান্ডার তৈরি করতে পারে না। গ্রাহকদের তথ্য অপারেটররা নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্যভান্ডার থেকেই যাচাই করে থাকে।

প্রথম আলোর খবর থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি মোবাইল অপারেটরদের তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য চিঠি দেয়। চিঠিতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) থেকে সেবা নিতে বলা হয়, যা পরিচালনা করে ডিজিকন টেকনোলজিস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

অভিযোগ রয়েছে, ডিজিকনকে ব্যবসা পাইয়ে দেওয়ার জন্যই তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। তথ্য দিতে জনপ্রতি ১০ টাকা দাবি করছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুবিভাগ থেকে প্রায় একই ধরনের সেবা পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ টাকায়।

গত ১৮ জানুয়ারি বিটিআরসি অংশীজনের সঙ্গে যে বৈঠক করে, তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, নাগরিকদের তথ্য পাওয়ার জন্য তাদের মোবাইল অপারেটরদের শরণাপন্ন হতে হয় না। অন্যদিকে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন (অ্যামটব) চিঠি দিয়ে বিটিআরসির সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছে।

প্রকৃত ঘটনা হলো মুঠোফোনে সিম বিক্রির সময় মোবাইল অপারেটররা গ্রাহকের কাছ থেকে যেসব তথ্য নেয়, সেগুলো যাচাই–বাছাই করতে হয় তথ্যভান্ডারের সহযোগিতা নিয়ে। তারা আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখে পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারের মাধ্যমে। গত ২৫ জানুয়ারির চিঠিতে বলা হয়েছে, মোবাইল অপারেটরদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরম পূরণ করতে হবে এবং তথ্য নিতে হবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচারের (বিএনডিএ) মাধ্যমে, যার একটি সেবার নাম পরিচয়। এটি আবার নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত। এর অর্থ ‘পরিচয়’ ইসির তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের মুনাফা হাতিয়ে নেবে। অথচ ইসি ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল পাবে নগণ্য ভাগ।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ‘পরিচয়’–এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরম পূরণ থেকে আয়ের ৮০ শতাংশ, ছবি যাচাইয়ের ৮৬ শতাংশ ও আঙুলের ছাপের ৯০ শতাংশ পাবে ডিজিকন। নৈতিকভাবে বিটিআরসি এমন কোনো নির্দেশ দিতে পারে না, যাতে একটি সুনির্দিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সুবিধা হয়। দ্বিতীয়ত, ইসির কাছে রক্ষিত তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কেন মুনাফা করার সুযোগ দেওয়া হবে?

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ যে যুক্তি দিয়েছেন, তা–ও গ্রহণযোগ্য নয়। তথ্য যাচাইয়ের আলাদা ব্যবস্থার নামে মোবাইল অপারেটদের ওপর ব্যয় চাপিয়ে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই, যেখানে ওই ব্যয় শেষ পর্যন্ত গ্রাহকের ওপর চাপবে।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের বেশ কিছু ঘটনা ঘটতে দেখেছি। বিপুলসংখ্যক নাগরিকের তথ্য কীভাবে ফাঁস হলো তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। তাই নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের ভান্ডার রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং সেখান থেকে সেবা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের দক্ষ প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত। জাতীয় তথ্যভান্ডারের বাইরে সমজাতীয় কোনো তথ্যভান্ডার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তৈরি করতে চাপ দেওয়া অনুচিত।