প্রসূতির পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবায় অবহেলা নয়

সম্পাদকীয়

করোনা মহামারির অভিঘাত বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি—জনস্বাস্থ্যবিদদের এমন পূর্বাভাস যে কতটা সত্য, তার একটা প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হতে পারে দেশে নবজাতক মৃত্যুর হার বৃদ্ধির বিষয়টি। মহামারির দুই বছর ২০২০ ও ২০২১ সালে বিধিনিষেধের কারণে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় নবজাতক মৃত্যুর হার কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ২০২২ সালে নবজাতক মৃত্যু একলাফে যেভাবে বেড়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যের বরাতে প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দেশে চার বছর ধরেই সরকারি হাসপাতালগুলোয় নবজাতক মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রতি হাজারে নবজাতক মৃত্যুর হার ছিল যথাক্রমে ১৬.৭৫, ১৬.৯৯ ও ১৭.৭১। ২০২২ সালে এই হার একলাফে বেড়ে হয়েছে ২৩.৫৫। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত ৫৮৬টি সরকারি হাসপাতালে ১০ হাজার ৫৮৩ (২৮ দিন পর্যন্ত বয়স) নবজাতক মারা গেছে।

বাংলাদেশ ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৫। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হলো প্রতি হাজারে নবজাতক মৃত্যুর হার ১২–তে নামিয়ে আনা। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জনে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা যে নেওয়া হয়নি, তা নবজাতক মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। দেশে নবজাতক মৃত্যু কেন এতটা বেড়ে গেল, সেটি খতিয়ে দেখে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি সংস্থার জরিপ বলছে, করোনা মহামারির দুই বছরে বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গত বছর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বেশির ভাগ মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। অবধারিতভাবেই এর প্রভাব পড়েছে গর্ভবতী মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবায়। চিকিৎসকেরা বলছেন, আর্থিক সংকটের কারণে অনেক মা গর্ভকালে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাননি, প্রসবপূর্ব সেবা নেননি।

গর্ভের সন্তানের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। এ সময় বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়াও নবজাতক মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ। আবার এটাও সত্য, খুব জটিল রূপ না নেওয়া পর্যন্ত অনেক পরিবার নবজাতকদের চিকিৎসকের কাছে নেয় না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ প্রবণতা বেশি।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে প্রসূতি মা ও শিশুমৃত্যু রোধে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। নবজাতক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই অগ্রগতি ধরে রাখতে না পারাটা দুঃখজনক। নবজাতক মৃত্যু রোধে, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, মায়ের পুষ্টি, প্রসব–পূর্ব ও প্রসব–পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা এবং নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। প্রসূতি মায়ের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবায় কোনো ধরনের অবহেলা কাম্য নয়।