আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩

সম্পাদকীয়

গোষ্ঠীস্বার্থ জনস্বার্থকে ছাপিয়ে গেলে সেটি জনস্বার্থ সংরক্ষণার্থে নিয়োজিত কাঠামোগত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে কিংবা আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

আনসার ব্যাটালিয়নকে অপরাধী আটক, তল্লাশি ও মালামাল জব্দ করার ক্ষমতা দিতে নির্বাচনের আগমুহূর্তে সরকার অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ায় যে উদ্যোগ নিয়েছে এবং তাতে পুলিশ বাহিনীর প্রকাশ্য আপত্তির জের ধরে যে অস্বস্তিকর অবস্থার উদ্ভব হয়েছে, তা সেই ধ্রুব সত্যটিকে আরও একবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

আনসার ব্যাটালিয়নের ক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩’ গত সোমবার জাতীয় সংসদে তোলার পর তা তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে আপত্তি করে পুলিশ বলছে, আনসার ব্যাটালিয়নকে এই ক্ষমতা দেওয়া হলে বিশৃঙ্খলা এবং দুই বাহিনীর মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে। আর আনসার বলছে, এই ক্ষমতা না দেওয়া হলে তাদের দায়িত্ব পালন কঠিন হবে।

ফল হিসেবে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিসংক্রান্ত আলোচনায় বিষয়টি এখন প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক তথা সামাজিক পরিসরে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বলেছেন, আনসার বাহিনীকে গ্রেপ্তারের অনুমতি কখনো দেওয়া হয়নি, আজকেও দেওয়া হবে না।

আলোচনায় মূলত দুটি বিষয় ঘুরেফিরে আসছে। একটি হলো জাতীয় নির্বাচনের দুই মাস আগে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়া করে কেন সরকার আনসার ব্যাটালিয়ন বাহিনীর সদস্যদের হাতে এসব ক্ষমতা দেওয়ার জন্য আগ্রহী হলো।

দেশের বিগত নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করার চেষ্টার যেসব নজির রেখে এসেছে, তাতে এই উদ্যোগকে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের একধরনের পরিকল্পনার ইঙ্গিত মনে করার অবকাশ থেকে যায়। এটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে ভীতি ও শঙ্কা ছড়ানোর অংশ বলেও বিবেচিত হতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো, ২০১৭ সালে ব্যাটালিয়ন আনসারের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও পুলিশের আপত্তির কারণে সেটি এত দিন আটকে ছিল। পুলিশ সে সময়ই বলেছিল, আইন প্রয়োগের জন্য একাধিক বাহিনীকে সহাধিকারক্ষেত্র দেওয়া হলে পারস্পরিক ভুল-বোঝাবুঝি ও দায়বদ্ধতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতভেদসহ নানাবিধ সমস্যা এবং আন্তবাহিনীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। দুই বাহিনীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে।

এই অবস্থায় ব্যাটালিয়ন আনসারের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয় নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে দুই বাহিনীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশদ আলোচনা করে পারস্পরিক সম্ভাব্য স্বার্থ সংঘাতের সব আশঙ্কা দূর করা দরকার ছিল। সেটি যে করা হয়নি, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে উভয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের আলোচনায় বসা এবং ঐকমত্যে পৌঁছানো ছাড়াই আলোচনা শেষ হওয়ার মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।

এমনিতেই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস ঘনীভূত হচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যে একটি বাহিনীকে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ায় অপরাধী আটক, তল্লাশি ও মালামাল জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া এবং তার কারণে আরেকটি বাহিনীর সংক্ষুব্ধ হওয়া মোটেও জনস্বার্থবান্ধব ফল বয়ে আনবে না।

যেহেতু বিষয়টি অতিশয় সংবেদনশীল, সেহেতু এ নিয়ে সরকারের তাড়াহুড়া নীতি অবলম্বন করা উচিত হবে না। প্রয়োজনে উভয় পক্ষের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। মোদ্দাকথা, ব্যাটালিয়ন আনসারের ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে যে আসন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার উদ্দেশে্যর দূরতম সম্পর্কও নেই, সেটি সরকারকে প্রমাণ করতে হবে। এই আইন যে গোষ্ঠীস্বার্থের আইন নয়; এই আইন যে জনস্বার্থের, সেটি সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে।