কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগে কেন গড়িমসি

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কারাগারকে সংশোধনাগার বলার একটা রেওয়াজ চালু হয়েছে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। তবে বাস্তবে ঔপনিবেশিক আমলের অমানবিক পরিবেশ থেকে দেশের কারাগারগুলোকে কতটা বের করে আনা গেছে, তা নিয়ে বড় প্রশ্নই রয়ে গেছে। গাদাগাদি করে বন্দীদের রাখা, নিম্নমানের খাবার দেওয়া—কারাগারের পরিবেশ নিয়ে এমন অভিযোগ সব সময়ই ছিল। কিন্তু বন্দীদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিও যেভাবে উপেক্ষা করে আসা হচ্ছে, সেটি এককথায় অমানবিক।

কারা অধিদপ্তরের বরাতে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত ৪ বছর ৯ মাসে কারাগারে মারা গেছেন ৯৩৩ জন। এর অর্থ বছরে গড়ে ১৯৬ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৭৫ জন বন্দী মারা গেছেন কারাগার থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে। অথচ দেশের ৭৪টি কারাগারে স্থায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২। এ তথ্যই বলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট যে কারাগারে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অবহেলা কতটা গভীর। অথচ বন্দীরা রাষ্ট্রের হেফাজতে থাকেন। তাঁদের সুচিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। 

মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান যথার্থই বলেছেন, কারাগারে কোনো বন্দীর অবহেলায় মৃত্যু হলে তার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। অথচ বছরের পর বছর ধরে গাদাগাদি করে বন্দী না রাখা, চিকিৎসক–সংকট কাটানো, খাবারের মান—এসব বিষয় নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছে। বাস্তবে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।

দেশের ৭৪টি কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা যেখানে ৪৬ হাজার, সেখানে থাকতে হচ্ছে প্রায় ৮২ হাজার জনকে। ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বন্দী থাকলে কারাগারের পরিবেশ কেমন হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়। কারাগারে অনেক বন্দীই আছেন, যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি অসুখ যেমন হৃদ্‌রোগ, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি ও লিভারের নানাবিধ অসুখে ভুগছেন। এ ছাড়া অনেক বন্দী আছেন, যাঁদের বয়স সত্তরের বেশি। তাঁদের সবারই নিয়মিত চিকিৎসা দরকার। অথচ দুটি কারাগার বাদে বাকি ৭২টিতে কোনো স্থায়ী চিকিৎসক নেই।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রেষণে কারাগারগুলোতে চিকিৎসক পাঠানো হলেও তাঁরা সকাল থেকে দুপুর বা বিকেল পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেন। ৭৪টি কারগারের জন্য অস্থায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ১০২। প্রশ্ন হচ্ছে, এত কমসংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে কীভাবে ৮২ হাজার বন্দীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব?

চিকিৎসকেরা যে কারা হাসপাতালে যেতে অনাগ্রহী, তার বাস্তব কারণও আছে। পদোন্নতির সুযোগ না থাকা, কাজের চাপ ও নন–কাডার কর্মকর্তার অধীন দায়িত্ব পালন করতে হয় বলে তাঁরা সেখানে যেতে চান না। সরকারকে অবশ্যই এই সমস্যার যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। বন্দীদের চিকিৎসাসেবার সুযোগ থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত করা যাবে না। কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগে গড়মসি করা যাবে না।