দুর্ঘটনার ওপর মানুষের হাত নেই। তাই বলে এমন দুর্ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না, যাতে বিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যাওয়া শিশুরা ফিরে এল লাশ হয়ে। এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২২ জন। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে দেড় শতাধিক আহত মানুষ চিকিৎসাধীন। একটি দুর্ঘটনায় এত বেশি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা বিরল। এ ঘটনায় কেবল স্বজনহারা পরিবার নয়, পুরো বাংলাদেশ শোকাহত।
সোমবার বেলা সোয়া একটায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করার কয়েক মিনিট পরই বিধ্বস্ত হয়। বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামও মারা গেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, বিমানবাহিনীর একটি এফ সেভেন বিজেআই ফাইটার এয়ারক্রাফট মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুল ভবনে ক্রাশ ল্যান্ডিং করে। ভবনের প্রথম তলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিশুদের ক্লাস। দ্বিতীয় তলায় ছিল দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস। টিচার্স রুমের কাছে যেখানটায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেখানে শিশুরা জড়ো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে হয়তো কিছু অভিভাবকও ছিলেন।
দুর্ঘটনার পর আগুনে পোড়া শিশুদের যখন উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সন্তানের খোঁজে আসা বাবা-মায়ের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, আগুনে পোড়া অনেক শিশুকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার স্ট্রেচারের অভাবে কাউকে কোলে করে, কাউকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই দৃশ্য আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলার অক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার লোক ছুটে আসেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁরা উদ্ধারকাজে সহায়তা করেছেন। অনেকে আহত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে হাসপাতালে ছুটে গেছেন। মানবিক দুর্যোগে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই দৃষ্টান্ত আমাদের আশান্বিত করে।
বিমানটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছে, তার কাছাকাছি আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। এ অবস্থায় মেট্রোরেলযোগে আহতদের দ্রুত জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এটা অনুসরণীয় কাজ বলে মনে করি।
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের আরও অনেক সদস্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে। অনেকে হাসপাতালে গেছেন।
শোকের পাশাপাশি এই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের সামনে কতগুলো নির্মম সত্য তুলে ধরেছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, একজন প্রশিক্ষণার্থী পাইলট বিমানটি চালাচ্ছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিমানের কোনো ত্রুটি বা চালকের কোনো বিচ্যুতি ছিল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। এর আগে বাংলাদেশে একাধিকবার প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও এতগুলো প্রাণহানি ঘটেনি। অন্যান্য দেশে এ ধরনের প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়নের ক্ষেত্রে অতি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। আমরা তা কতটা করছি, সেখানে কোনো ঘাটতি আছে কি না, ভবিষ্যতে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা এড়াতে সেই মূল্যায়ন জরুরি।
যে শিক্ষার্থীরা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে আছে, তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার যে আশ্বাস সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, আশা করি তা নিশ্চিত করা হবে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় দেশবাসীর সঙ্গে প্রথম আলো পরিবারও শোকাহত এবং স্বজনহারা পরিবারের সদস্যদের প্রতি রইল আমাদের গভীর শোক ও সমবেদনা।