আমাদের আরও আফরিন আরা দরকার

সম্পাদকীয়

যে দেশে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, সে দেশে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা আফরিন আরা একজন সত্যিকারের নায়ক। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, আফরিন আরা ২০১৩ সালে এই কেন্দ্রে কাজে যোগ দেন।

তাঁর হাতে গত ১০ বছরে ২ হাজার ২০০টি শিশু জন্মেছে। আফরিন সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন। এমনকি সন্তান প্রসবের জন্য ডাক পড়ায়, মৃত্যুর আগে বাবাকেও শেষবারের মতো দেখতে পাননি। ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবের সময়ও আফরিন ব্যস্ত থাকেন কাজে।

তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন যেদিন ছাপা হয়, তার দিন দুয়েকের মাথায় প্রথম আলোর শীর্ষ খবর ছিল, ‘বিবিএসের তথ্য/ অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম অস্ত্রোপচারে’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি দেশে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচার দরকার হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হচ্ছে ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে।

মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রস্তুত করতে একজন গর্ভবতী মাকে যে সময় দেওয়া দরকার, অস্ত্রোপচারে তত সময় দিতে হয় না। ফলে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারে বেশি আগ্রহী। অন্যদিকে গর্ভবতী মায়েরাও স্বাভাবিক প্রসবের যন্ত্রণার ভয়ে অনেক সময় চিকিৎসকদের অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেন।

স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্মদানের ব্যাপারটা এখন বিস্ময়কর হয়ে উঠলেও, চুয়াডাঙ্গার বেগমপুর ইউনিয়নে এটাই এখন স্বাভাবিক। সমস্যা হলো অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের যে ঝুঁকি, সে সম্পর্কে খুব প্রচার-প্রচারণা নেই। ফলে মায়েরা স্বাভাবিকের চেয়ে অস্ত্রোপচারকে শ্রেয় মনে করেন। অথচ চিকিৎসকেরাই বলছেন, অস্ত্রোপচারে মায়ের শরীরে ক্ষত হয়, বাড়তি ওষুধ খেতে হয়। তা ছাড়া স্বাভাবিক প্রসবের সময় মায়ের শরীরে থাকা উপকারী জীবাণু নবজাতক পায়, যেটা অস্ত্রোপচারে জন্ম নেওয়া শিশুরা পায় না। অস্ত্রোপচারে খরচও অনেক বেশি।

অস্ত্রোপচারে প্রসবের বেপরোয়া গতি রুখতে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা অস্ত্রোপচারের ‘অডিট’ করা জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন। কেন অস্ত্রোপচার করতে হলো, এই ব্যাখ্যা প্রদান বাধ্যতামূলক করা গেলে হয়তো স্বাভাবিক প্রসবের হার বাড়বে। সেই সঙ্গে মায়েদের উদ্দীপ্ত করাও প্রয়োজন।

চুয়াডাঙ্গার আফরিন আরা ঠিক সেই কাজই করছেন। তিনি মায়েদের স্বাভাবিক প্রসবে উৎসাহিত করছেন নিয়মিত। সুফলও পাচ্ছেন। যে গর্ভবতী নারীরা গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা নেন না, বাড়িতে সন্তান প্রসব করাতে চান অদক্ষ হাতে, তাঁরা ঠিকই বেগমপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে যাচ্ছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন আস্থার নাম।

এর আগেও আমরা দেখেছি, বগুড়ার ধুনট ও কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গর্ভবতী মায়েরা স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন নিয়মিত। আমরা মনে করি, আফরিন আরাসহ আরও যাঁরা স্বাভাবিক প্রসব নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এতে অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহী হয়ে উঠবে।