সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বাধা অপসারিত হোক

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে তিন প্রজন্মের নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীরা সংবাদ সম্মেলন করে যে উদ্বেগ জানিয়েছেন, তা প্রত্যেক সংস্কৃতিসেবী তথা সচেতন মানুষের মনোভাব। নানা রকম নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে গল্প বলার যে স্বাধীনতা তাঁরা দাবি করেছেন, তা খুবই যৌক্তিক।

যেসব সরকারি কর্মকর্তার হাতে শিল্প-সংস্কৃতি দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা এ কাজের কতটা উপযুক্ত, সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেক আগে থেকেই। পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী শনিবার বিকেল নামে যে চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছেন, সেটি সাড়ে তিন বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে। অথচ চলচ্চিত্রটির কোথায় আপত্তি, সেই ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করেননি তাঁরা। আইনে নাকি ব্যাখ্যা দেওয়ার বিধান নেই। এ ধরনের ঔপনিবেশিক আইন স্বাধীন বাংলাদেশে কেন থাকবে? সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান, বোর্ড ও ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক—যে কেউ একটি ছবির সেন্সর বাতিল করতে পারবেন, এটা কোনো আইন হতে পারে না। এই প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাতারা ও শিল্পীরা সেন্সর বোর্ড বাতিলের যে দাবি জানিয়েছেন, আমরা তা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে একটি আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন প্রণয়ন এবং ওটিটি নীতিমালা প্রণয়নের যে দাবি তাঁরা তুলেছেন, তার সঙ্গেও সহমত প্রকাশ করছি।

জীবনের বাস্তবতা ও শিল্পের বাস্তবতা যে এক নয়, সেই সত্যটা বোঝার ক্ষমতাও সরকারি কর্মকর্তাদের নেই। দর্শকদের কাছে বিপুলভাবে নন্দিত হাওয়া ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করেছে বন বিভাগ। অথচ আলোচ্য চলচ্চিত্রে বন্য প্রাণী আইন লঙ্ঘনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ছবির পরিচালক বলেছেন, ‘নির্মাতা হিসেবে আমি এটুকুই বলতে চাই, হাওয়ার পাখিটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে আর এই নির্মাণের জন্য যে সিনেমাটিক রিয়েলিটি তৈরি করতে হয়েছে, সেটা সত্য নয়। ছবির শুরুতে ডিসক্লেইমারে আমরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছি। পাখির দৃশ্য ধারণের পর আমরা তাকে প্রকৃতিতে মুক্ত করে দিয়েছিলাম।’

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংস্কৃতিসেবী নাসির উদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শিল্প-সংস্কৃতি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত আমলাদের বেশির ভাগই বিষয়টি বোঝেন না। তাঁরা সবকিছু আক্ষরিক অর্থে দেখেন।

এর আগেও একাধিক নাটক ও চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলার উদ্দেশ্য শিল্প-সংস্কৃতির টুঁটি চেপে ধরা। এ ধরনের পরিবেশে সুস্থ ও সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা কেবল দুরূহ নয়, প্রায় অসম্ভব।

যখন দেশে একটি মহল চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রা, পালাগান ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিরামহীন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রশাসনের কোনো কোনো অংশ থেকে এ ধরনের বৈরী আচরণ সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে বৈকি। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র, নাটক, মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালা যাঁরা করেন, তঁাদের অনেক সামাজিক বাধা অতিক্রম করতে হয়।

যেখানে সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া আছে, সেখানে কেন নানা ছলছুতায় একের পর এক চলচ্চিত্র আটকে দেওয়া এবং নির্মাতাদের হয়রানি করা হবে? চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে জাই, এ অবস্থার অবসান হোক। সুস্থ ও সৃজনশীল সংস্কৃতিচর্চার বাধাগুলো অপসারিত হোক।