মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর মুক্তিযুদ্ধ–সম্পর্কিত বহু স্থাপনা ও প্রতিকৃতি দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছে। ১৬ মাসের বেশি সময় পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেগুলো সংস্কার বা পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেয়নি। এ অনীহার কারণ স্পষ্ট নয়। এদিকে বীরশ্রেষ্ঠদের নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরগুলো পড়ে আছে অচলাবস্থায়। দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা এসব প্রতিষ্ঠান আজ অবহেলা, জনবলসংকট ও পরিকল্পনাহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নোয়াখালী, ফরিদপুর, ভোলা, নড়াইলসহ একাধিক জেলার বীরশ্রেষ্ঠ স্মৃতি জাদুঘরগুলোতে দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। জীর্ণ ভবন, ভাঙা আসবাব, অচল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, নিয়মিত খোলা না থাকা, পর্যাপ্ত বই ও প্রদর্শনীর অভাব। কোথাও লাইব্রেরিয়ান নেই বছরের পর বছর, কোথাও একজন কেয়ারটেকারই পুরো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে। ফলে দর্শনার্থী ও পাঠকের সংখ্যা কমছে, রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়নের অভাবে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংযোগ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার ঘাটতি। জেলা পরিষদ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কার্যকর সংস্কার, জনবল নিয়োগ বা আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোথাও কোটি টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণ করা হলেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে তা প্রায় অকার্যকর। কোথাও আবার যোগাযোগব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে পাঠক ও দর্শনার্থীরা সেখানে পৌঁছাতেই পারেন না।
অন্যদিকে ঝিনাইদহের হামিদুর রহমান গ্রন্থাগার তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকলেও সেখানেও স্থায়ী জনবল ও উপযুক্ত পারিশ্রমিকের অভাব রয়েছে। ন্যূনতম পরিকল্পনা ও স্থানীয় সম্পৃক্ততা থাকলে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যকর হতে পারে। বীরশ্রেষ্ঠদের স্মৃতি সংরক্ষণ কোনো আনুষ্ঠানিক দায় নয়, এটি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। শুধু ভবন নির্মাণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। প্রয়োজন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, স্থায়ী জনবল নিয়োগ, আধুনিক প্রদর্শনী, গবেষণা উপকরণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ। জাতীয় দিবসকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং সারা বছর ধরে কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানকে জীবন্ত রাখতে হবে।
আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বীরশ্রেষ্ঠদের নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরগুলোর প্রতি অবিলম্বে দৃষ্টি দেবে। জনবলসংকট দূর করে স্থায়ী নিয়োগ, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং আধুনিক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ গড়ে তুলে গবেষণা, পাঠচক্র ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়ানো হবে। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করে দর্শনার্থীদের প্রবেশ সহজ করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ কেবল অতীত স্মরণ নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাগরিক চেতনা গঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দায়িত্বে অবহেলা চলতে পারে না। সমন্বিত পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বাজেট ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান টেকসই হবে না। জনস্বার্থে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশিত।