সম্প্রতি আইএমএফের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনাকালে অর্থনীতির যে খাতটির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সেটি ব্যাংকিং খাত। সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও তারা ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের কথা কেবল বিদেশিরাই বলেছেন, তা নয়। দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক-বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন।
ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার কারণ কী? এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর পাওয়া গেল মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) প্রথম আলোয় প্রকাশিত শওকত হোসেনের প্রতিবেদনে। ব্যাংক অর্থ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে যে হারে সুদ দেয়, গ্রাহকদের কাছ থেকে স্বাভাবিকভাবেই তার থেকে বেশি হারে সুদ নিয়ে থাকে। দুই সুদের হারের নয়–ছয়ের ওপরই ব্যাংকিং ব্যবসা টিকে থাকে।
কিন্তু ঋণগ্রহীতারা যদি ঋণ ফেরত না দেন এবং বছরের পর বছর খেলাপি হতে থাকেন, তাহলে ব্যাংকিং ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে বাধ্য। অতি সাম্প্রতিক কালে খেলাপি ঋণের জন্য ‘দুষ্ট ঋণগ্রহীতারা’ করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করলেও অতীতের হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের কোনো ব্যাখ্যা নেই।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, জ্যামিতিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। যেখানে ১৯৯০ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা, ২০২২ সালে তার পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ হয়েছে গত ১৪ বছরে অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগের আমলে।
আমরা লক্ষ করছি, সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় মস্ত বড় গলদ আছে। তারা খেলাপি ঋণ উদ্ধারে সচেষ্ট না হয়ে বারবার ঋণখেলাপিদের আবদার রক্ষা করেছে কখনো খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে, কখনোবা মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে। এসব ঋণগ্রহীতা ঋণ নিয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, আবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাও বদল দিয়েছেন সরকারকে চাপ দিয়ে।
এই দ্বিমুখী চাপের কারণে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ঋণখেলাপিদের কারণে সৎ ঋণগ্রহীতা, যাঁরা নিয়মিত ঋণ শোধ করেন, তাঁরাও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ব্যাংকের কোনো ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ শোধ না করে পার পেয়ে যান, অন্যরা কেন ঋণ শোধ করবেন?
দেশের অর্থনীতি বা ব্যাংকিং ব্যবস্থা চলে আইনকানুনের ভিত্তিতে। যাঁরা আইন মেনে চলেন, তাঁরা যেমন পুরস্কৃত হওয়ার কথা, তেমনি আইন অমান্যকারী ব্যক্তিদের শাস্তি পাওয়ার কথা।
কিন্তু বাংলাদেশে ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে উল্টো নিয়মই দেখা যাচ্ছে। বড় ঋণখেলাপিরাই সরকারের ওপর বেশি খবরদারি করছেন। সরকারি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকার ‘ভর্তুকি’ দিয়ে ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখছে।
এরপর ঋণখেলাপিরা বেসরকারি ব্যাংকের ওপর ভর করেন। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করারও অভিযোগ আছে।
দেশের অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেখানে তাদের অন্যায্য দাবির কাছে নতিস্বীকার করছে। একের পর এক অন্যায্য সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।
এর পরিণতি কি নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখেছেন? দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের কথায় কর্ণপাত না করলেও সরকার অন্তত আইএমএফের সাবধানবাণী আমলে নিক।
মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে এবং বারবার ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা তথা সার্বিক অর্থনীতি বাঁচাতে হলে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেই হবে।