শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় বাড়াতে হবে

সম্পাদকীয়

উচ্চশিক্ষার পেছনে সরকার যে অর্থ ব্যয় করে, তার সুবিধা কারা কী পরিমাণ পায়? এখানে সমতা আছে, না চরম বৈষম্য? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের ব্যয়ের যে তথ্য উঠে এসেছে, তা হতবাক করার মতো।

এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের সঙ্গে আরেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের আকাশ-পাতাল ফারাকটা অস্বাভাবিকই বটে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার ব্যয় করে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৭ টাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাধিক। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করা হয় মাত্র ১ হাজার ১৫০ টাকা।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২ হাজার ২৫৭টি কলেজের শিক্ষার্থী আছেন ৩০ লাখ। এর মধ্যে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে আছেন ১৫ লাখের মতো। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় ১ হাজার ৭৮৬ টাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পড়াশোনা করেন ছয় লাখ শিক্ষার্থী।

এ কথা ঠিক যে সাধারণ শিক্ষা থেকে বিশেষায়িত শিক্ষা, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, প্রকৌশল, বিজ্ঞান, কৃষি ও কারিগরি শিক্ষার ব্যয় বেশি হবে। তাই বলে মাথাপিছু ব্যয়ের ফারাক কয়েক শ গুণ হতে পারে না। যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে সর্বনিম্ন ব্যয় হয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় সবাই কলা ও বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশোনা করেন না। সেখানকার শিক্ষার্থীদের একাংশ বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করে থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়কে ভিত্তি ধরা হয়, তা হলো অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথাপিছু ব্যয় কিছুটা বেশি হতে পারে। তাই বলে কয়েক শ গুণ হতে পারে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষায় ব্যয় কম, সেখানে শিক্ষার্থীরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

লোকবলকাঠামো অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় শিক্ষার্থীদের অনুপাতে যে পরিমাণ শিক্ষক থাকার কথা, প্রকৃতপক্ষে থাকেন এর চেয়ে অনেক কম। বিভিন্ন বিভাগে বহু পদ খালি থাকে। শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষাও সময়মতো হয় না। অনেক পুরোনো কলেজেও বহু পদ খালি থাকাটা অনিয়মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় মানসম্মত শিক্ষা আশা করা যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ব্যয়ের হিসাবের যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইউজিসির প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথাপিছু ব্যয় দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ২১ হাজার ২৩৮ ও ২৩ হাজার ৯৬০ টাকা। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, সেখানে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের পরিমাণ ২ লাখ ১২ হাজার টাকা।

হিসাবের এই মারপ্যাঁচ বাদ দিলেও স্বীকার করতে হবে, যে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী, সেখানেই শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় সবচেয়ে কম। অথচ কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মান স্তরেই ১৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন মাত্র ৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৩০ জন।

যদি সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সুদক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, সেখানকার শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়াতেই হবে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কম বরাদ্দ দিয়ে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা আশা করা দিবাস্বপ্নই বটে।