দ্রুত অচলাবস্থার অবসান হোক

সম্পাদকীয়

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল অস্বাভাবিক নয়, উদ্বেগজনকও। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর সেখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের পর গত সাড়ে চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো অঘটন ঘটেনি।

কিন্তু ২০২৪ সালের মার্চের শেষে এসে হঠাৎ অচলাবস্থা দেখা দিল কেন? আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন, পরীক্ষা বর্জন করেছেন। অন্যদিকে গতকাল ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি চালু করার দাবি জানিয়েছে।

গত বুধবার মধ্যরাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাদের যাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূচনা। রাত সাড়ে ১০টার পর বুয়েট শিক্ষার্থীদেরই সেখানে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে যে দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল, এখন কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে মধ্যরাতে ছাত্রলীগকে সেখানে প্রবেশ করতে হবে?

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রবেশের প্রতিবাদে এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করছেন। তাঁরা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে যাওয়ার কাজে সহায়তার জন্য বুয়েটের ছয় শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কারসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার শিক্ষার্থীদের কোনো কোনো দাবির সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেও তাঁদের পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।

বুয়েট ক্যাম্পাসের ঘটনা আর বুয়েটের মধ্যে সীমিত নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুয়েটের আন্দোলনের পেছনে জঙ্গিবাদীদের ইন্ধন আছে কি না, খতিয়ে দেখতে বলেছেন। বুয়েটে জঙ্গি ও মৌলবাদী সংগঠনের তৎপরতার অভিযোগ করেছেন শিক্ষামন্ত্রীও। বুয়েটে উগ্রবাদী তৎপরতা আছে কি না, সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্ত করে দেখার বিষয়। এ বিষয়ে ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কিছু করণীয় নেই।

ছাত্রলীগ বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবি জানিয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি বলতে তারা কী বোঝাচ্ছে? নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি হতে হবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে এবং এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার আছে কেবল নির্বাচিত ছাত্র সংসদের।

বুয়েটে যাঁরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দাবি জানাচ্ছেন, তাঁরা অন্যান্য ক্যাম্পাসে অন্য ছাত্রসংগঠনকে সহাবস্থানের সেই সুযোগ দিচ্ছেন কি না, সেই প্রশ্নও আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু থাকার অর্থ হচ্ছে, সব ছাত্রসংগঠন সেখানে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে এবং ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি না করে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা ও শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সেই পরিস্থিতি নেই, তাই নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির যে কথা ছাত্রলীগ বলেছে, তা অর্থহীন।

তবে আমরা মনে করি, বুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরও এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এতে তাঁরা যে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলন করছেন, তঁারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা পাক, এটা সবার দাবি। পড়াশোনা বন্ধ হোক, সেটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আমরা আশা করব তদন্ত কমিটি একটি যথাযথ প্রতিবেদন হাজির করবে এবং সে অনুযায়ী বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক, পরীক্ষা ও ক্লাস চলুক—এটাই সবার প্রত্যাশা।