ছাত্রলীগ কেন প্রকৌশলীদের মারে

সম্পাদকীয়

যখন দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল, তখন স্থানীয় গ্রাহকদের ঘেরাও-বিক্ষোভ থেকে রক্ষা পেতে সরকার বিভিন্ন বিদ্যুৎ কার্যালয়ের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল।

কিন্তু সম্প্রতি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার পেছনে গ্রাহকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের কোনো বিষয় ছিল না। ছাত্রলীগের নেতারা ‘অবাধ্য প্রকৌশলীকে’ শাস্তি দিতে কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটান।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদের ডাকে নেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী রকি চন্দ্র রায় স্থানীয় তুষভান্ডার রেলস্টেশন এলাকার অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর কার্যালয়ে দেখা করতে না যাওয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে।

রকি চন্দ্র রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁদের কার্যালয়ের মিটার রিডার শাহিনুর ইসলাম তাঁকে জানান, রাকিব (মন্ত্রিপুত্র) তাঁকে সন্ধ্যার পর অন্বেষা ক্লাবে ডেকেছেন। তিনি তাঁকে (শাহিনুর) বলেন, বাসায় তাঁর দুই স্বজন অসুস্থ, তিনি যেতে পারবেন না। সোমবার বিকেলে তিনি যখন রংপুরে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে ছিলেন, তখন কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল তাঁকে ফের অন্বেষা ক্লাবে যেতে বলেন। তিনি উপজেলার বাইরে থাকায় যেতে পারেননি।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে ছাত্রলীগের নেতারা নির্বাহী প্রকৌশলী রকি চন্দ্র রায়ের কার্যালয়ে এসে না যাওয়ার কারণ জানতে চান। তিনি বলেন, ‘এটা অফিসের ডেকোরামের মধ্যে পড়ে না যে মন্ত্রীর ছেলে ডাকলে আমাকে যেতে হবে।’ তখন শরিফুল ইসলাম, নুরুন্নবী প্রমুখ তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং অফিসের আলমারি ভাঙচুর করেন, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ভেঙে ফেলেন এবং উপসহকারী প্রকৌশলীদের চড়থাপ্পড় দিয়ে বের করে দেন। এ সময় কর্মচারীদেরও মারধর করা হয়।

যে রাকিবুজ্জামান আহমেদের নাম করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিদ্যুৎ অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করেছেন, তিনি এই ঘটনার দায় পুরো অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, নির্বাহী প্রকৌশলী রকি চন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক আছে এবং উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলামসহ অন্যরা তাঁর নাম ভাঙিয়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছেন।

নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে যদি রাকিবুজ্জামানের এত ভালো সম্পর্কই থাকবে, তাহলে তিনি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দিয়ে তাঁকে ডেকে না পাঠিয়ে সরাসরি কথা বললেন না কেন? জেলা আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে তিনি তো নির্বাহী প্রকৌশলী বা অন্য কোনো কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠাতে পারেন না। মন্ত্রী-তনয় হলেই যা খুশি করা যায় না।

কেবল লালমনিরহাটে ছাত্রলীগের এক দল নেতা-কর্মী নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করেননি। যেখানে সরকারের দরপত্র আহ্বান, উন্নয়নকাজ—সেখানেই ক্ষমতার দৌরাত্ম্য লক্ষ করা যায়। এক দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা রাজু মুন্সি চাঁদা না পেয়ে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীকে মারধর করেছেন। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাজু মুন্সির ছাত্রত্ব অনেক আগে শেষ হলেও তিনি হলের একটি কক্ষ দখল করে আছেন।

নেসকো ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। আমরা আশা করব, তদন্তে বেরিয়ে আসবে মন্ত্রিপুত্রের নাম ভাঙিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, না এর পেছনে তাঁর প্ররোচনা ছিল। কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, তঁারা লিখিত অভিযোগ পাননি।

যে ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটেছে, আলামত আছে, সে ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করতে হবে কেন? যাঁরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া কি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? নেসকো অফিসে হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হোক।