হরতাল-অবরোধের নামে সম্পদ ধ্বংস নয়

গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই দেশ পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সে হোক সরকারি বা বিরোধী দলের, তাঁরা প্রায়ই সেই সীমারেখা মানেন না।

যখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক, এটা বলা যায় না। নির্বাচনের তফসিলকে সরকারি দল সোল্লাসে স্বাগত জানালেও বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করেছে। গত ২৯ অক্টোবর থেকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকারের পদত্যাগের দাবিতে হরতাল-অবরোধ পালন করে আসছে।

তফসিল-পূর্ববর্তী বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। নতুন করে তারা রোববার থেকে দুই দিনের হরতাল আহ্বান করেছে। অন্যদিকে সরকার ২৮ অক্টোবরের নাশকতার অভিযোগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপির ৮ হাজার ৯৩৮ জন নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঢাকায় গ্রেপ্তার নেতা-কর্মীর সংখ্যা ২ হাজার ৭৫৩ জন। বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। 

তফসিল ঘোষণাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা পরিহার করে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। ভোটার ও ভোটের নিরাপত্তার জন্যও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অপরিহার্য। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তার ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা অব্যাহত থাকলে সেটি কী করে সম্ভব? 

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনসংক্রান্ত প্রশাসনিক দায়িত্বটা কমিশনের ওপর ন্যস্ত হয়। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থান করিবেন।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণাকালে যে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ওপর জোর দিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো তা আমলে নিয়েছে বলে মনে হয় না। একদিকে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে, অন্যদিকে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নানা রকম নাশকতার ঘটনা ঘটছে। বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি কতটা সফল কিংবা ব্যর্থ, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলতে চাই, এসব কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যে বাস, ট্রেন, ট্রাকে আগুনের ঘটনা, তা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সম্পদহানির এই মহড়া বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। 

এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। সারা দেশকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পরও কীভাবে কথিত দুষ্কৃতকারীরা নাশকতার ঘটনা ঘটাচ্ছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আচরণ শুরুতেই পক্ষপাতদুষ্ট। পুলিশের অভিযান সত্ত্বেও সরকারি দলের নেতাদের প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে। 

সরকার ও নির্বাচন কমিশন যদি সত্যি সত্যি নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ তৈরি করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। নাশকতার অভিযোগে বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া ভালো নজির নয়। 

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকট সমাধানে সব পক্ষকে সহনশীল ও সহিষ্ণু আচরণ করতে হবে। বিশেষ করে সরকারকে বুঝতে হবে বলপ্রয়োগ বা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাইকারি গ্রেপ্তার পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাবে। বিরোধী দলের যেসব নেতা-কর্মীকে গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। সে ক্ষেত্রে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা হলেও শীতল হতে পারে।